প্রতিকূল পরিবেশে খাদ্য অনুসন্ধান, আত্মরক্ষা, বংশবিস্তার— এই ধরনের
শারীরবৃত্তীয় প্রয়ােজনে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী এক স্থান থেকে অন্য
স্থানে যায়। যে পদ্ধতিতে প্রাণী নিজ চেষ্টায় সাময়িকভাবে এক | স্থান থেকে
অন্য স্থানে যায়, তাকে ঐ প্রাণীর চলন বলে। যে তন্ত্র দেহের কাঠামাে গঠন
করে, নির্দিষ্ট
আকৃতি দেয় এবং বিভিন্ন অঙ্গকে বাইরের আঘাত থেকে রক্ষা করে এবং চলনে
সাহায্য করে, তাকে কঙ্কালতন্ত্র বলে।
| এ অধ্যায়ে আমরা কঙ্কালতন্ত্রের গঠন, কাজ এবং এর রক্ষণাবেক্ষণ সম্পর্কে
জানতে পারব।
এই অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা:
• মানবকঙ্কালের বর্ণনা করতে পারব। • দৃঢ়তা প্রদান এবং চলনে কঙ্কালের
ভূমিকা ব্যাখ্যা করতে পারব। • বিভিন্ন প্রকার অস্থি ও অস্থিসন্ধির কাজ
ব্যাখ্যা করতে পারব। • পেশির ক্রিয়া ব্যাখ্যা করতে পারব। • টেনডন ও
লিগামেন্টের কাজ ব্যাখ্যা করতে পারব। • অস্টিওপােরােসিসের কারণ, লক্ষণ ও
প্রতিকার বর্ণনা করতে পারব। • আথ্রাইটিসের কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকার বর্ণনা
করতে পারব।
অস্টিওপােরােসিস ও আথ্রাইটিসের কারণ অনুসন্ধান করতে পারব। | মানবকঙ্কালের
বিভিন্ন অংশের চিত্র অঙ্কন করে চিহ্নিত করতে পারব।
অস্থির সুস্থতা রক্ষায় সচেতনতা সৃষ্টি করতে পারব।
9.1 মানবকঙ্কালের সাধারণ পরিচিতি।
একটি ঘর তৈরি করতে হলে প্রথম এর কাঠামাে বানাতে হয়। আমাদের দেহের কাঠামাে
হলাে কঙ্কাল (Skeleton)। লম্বা, ছােট, চ্যাপ্টা এবং অসমান মােট 206টি অস্থি
দিয়ে পূর্ণবয়স্ক মানুষের কঙ্কাল গঠিত হয়। শিশুর কঙ্কালে অস্থির সংখ্যা
আরও বেশি থাকে। এটি মানবদেহকে নির্দিষ্ট আকার দেয়। হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস,
পাকস্থলী, অন্ত্র, মস্তিষ্ক— এরকম দেহের কোমল অংশগুলােকে অস্থি দিয়ে তৈরি
আবরণ সুরক্ষিত রাখে। অস্থি দিয়ে তৈরি শক্ত কাঠামাে ছাড়া দেহের স্থিতিশীল
আকার সম্ভব নয়। মানবদেহের সব অস্থি এবং এদের সাথে সম্পৃক্ত অন্যান্য অংশ
মিলে কঙ্কাল তৈরি হয়। অস্থি এবং তরুণাস্থি দুটোই কঙ্কালের
অংশ। অস্থিসন্ধি অস্থিতন্ত্রের অংশগুলােকে সংযুক্ত করে এবং অস্থির চলনে
সাহায্য করে। অস্থিগুলাে ঐচ্ছিক মাংসপেশি দিয়ে পরস্পর সংলগ্ন থাকায়
ইচ্ছামতাে অঙ্গ সঞ্চালন এবং চলাফেরা করা সম্ভব হয়। অর্থাৎ অস্থি এবং
তরুণাস্থি, পেশি, পেশিবন্ধনী এবং অস্থিবন্ধনী নিয়ে কঙ্কালতন্ত্র গঠিত।
মানবদেহের কঙ্কালতকে দুটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়, বহিঃকঙ্কাল এবং
অন্তঃকঙ্কাল।
বহিঃকঙ্কাল (Exoskeleton); কঙ্কালের এ অংশগুলাে বাইরে অবস্থান করে, নখ,
চুল, কিংবা লােম এর অন্তর্ভুক্ত। অন্তঃকঙ্কাল (Endoskeleton): কঙ্কাল বলতে
আমরা আসলে শরীরের ভিতরকার অন্তঃকঙ্কালই বুঝি। কঙ্কালের এ অংশগুলাে আমরা
বাইরে থেকে দেখতে পাই না। অস্থি এবং তরুণাস্থি দিয়ে এই কঙ্কালতন্ত্র গঠিত।
9.1.1 দৃঢ়তা প্রদান এবং চলনে কঙ্কালের ভূমিকা। কঙ্কালের সাহায্যে
নিম্নলিখিত কাজ সম্পন্ন হয়:
(a) দেহকাঠামাে গঠন; কঙ্কাল মানবদেহকে একটি নির্দিষ্ট আকার ও কাঠামাে দান
করে। এটি। নিচের অঙ্গগুলাের সাথে উপরের অঙ্গগুলাের সংযুক্তি সাধন করে। (b)
রক্ষণাবেক্ষণ ও ভারবহন: মস্তিষ্ক করােটির মধ্যে, মেরুরজ্জ্ব মেরুদণ্ডের
ভিতরে এবং হৃৎপিণ্ড ও ফুসফুস বক্ষগহ্বরে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকে। পেশিগুলাে
কঙ্কালের সাথে আটকে থাকে এবং দেহের ভারবহনে সাহায্য করে।
(e) নড়াচড়া ও চলাচল: হাত, পা, কচক্র ও শ্রোণিচক্র নড়াচড়ায় সাহায্য
করে। এ কাজে পেশিতন্ত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অস্থির সাথে পেশি
আটকানাের ফলে অস্থি নাড়ানাে সম্ভব। হয় এবং আমরা চলাচল করতে পারি। (d)
লােহিত রক্তকণিকা উৎপাদন: অস্থিমজ্জা থেকে লােহিত রক্তকণিকা উৎপন্ন হয়।
(e) খনিজ লবণ সঞ্চয়: ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, ফসফরাস ইত্যাদি খনিজ লবণ
অস্থি সঞ্চয় করে রাখে। এতে অস্থি শক্ত এবং মজবুত থাকে।
9.1.2 অস্থি, তরুণাস্থি এবং অস্থিসন্ধি (Bone, cartilage এবং Joint)
অস্থি (Bone) অস্থি যােজক কলার রূপান্তরিত রূপ। এটি দেহের সবচেয়ে দৃঢ়
কলা। অস্থির মাতৃকা বা আন্তঃকোষীয় পদার্থ এক ধরনের জৈব পদার্থ দিয়ে গঠিত।
মাতৃকার মধ্যে অস্থিকোষগুলাে ছড়ানাে থাকে। একদিকে
অস্থির পুরাতন অংশ ক্ষয় হতে থাকে এবং অন্যদিকে অস্থির মধ্যে নতুন অংশ গঠন
হতে থাকে। | এই ভারসাম্য নষ্ট হলে অস্থির বিভিন্ন ধরনের রােগ হয়। বয়স
বাড়লে অবশ্য এমনিতেই ভারসাম্যটি হাড় ক্ষয়ের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ে। অস্থি
মূলত ফসফরাস, সােডিয়াম, পটাশিয়াম এবং ক্যালসিয়ামের
বিভিন্ন যৌগ দিয়ে তৈরি। এছাড়া অস্থিতে প্রায় 40-50 ভাগ পানি থাকে। জীবিত
অস্থিকোষে 40% | জৈব এবং 60% অজৈব যৌগ পদার্থ নিয়ে গঠিত। অস্থি বৃদ্ধির
জন্য ভিটামিন 'ডি' এবং ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার প্রয়ােজন। এসব খাবারের
অভাবে অস্থির স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। সূর্যের আলাে ত্বকে অবস্থিত
কোলেস্টেরলের এমন রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটায়, যা যকৃৎ এবং বৃক্কে আরও কিছু
ধারাবাহিক পরিবর্তনের পর ভিটামিন ডি সংশ্লেষণ করে। তাই পর্যাপ্ত পরিমাণ
সূর্যালােকের সংস্পর্শে আসা উচিত। যারা সবসময় ঘরে বসে থাকেন বা সারা শরীর
আবৃতকারী পােশাক পরেন, তাদের ভিটামিন ডি এর ঘাটতি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি
থাকে।
তরুণাস্থি (Cartilage) তরুণাস্থি অস্থির মতাে শক্ত নয়। এগুলাে অপেক্ষাকৃত
নরম এবং স্থিতিস্থাপক। এটি যােজক কলার ভিন্নরুপ। এর কোষগুলাে একক বা
জোড়ায় জোড়ায় খুব ঘনভাবে স্থিতিস্থাপক মাতৃকাতে বিস্তৃত থাকে। তরুণাস্থি
কোষগুলাে থেকে কন্ড্রিন নামক এক ধরনের শক্ত, ঈষদচ্ছ রাসায়নিক বস্তু বের
হয়। মাতৃকা কন্ড্রিন দিয়ে গঠিত, এর বর্ণ হালকা নীল। জীবিত অবস্থায়
তরুণাস্থি কোষের প্রােটোপ্লাজম খুব স্বচ্ছ এবং নিউক্লিয়াসটি গােলাকার
থাকে। কন্ড্রিনের মাঝে গহ্বর দেখা যায়। এগুলােকে ক্যাপসুল বা ল্যাকিউনি
বলে। এর ভিতর কব্লিাস্ট বা কন্দ্রিওসাইট থাকে। সব তরুণাস্থি একটি তন্তুময়
যােজক কলা নির্মিত আবরণী দিয়ে পরিবেষ্টিত থাকে, একে পেরিকন্ড্রিয়াম বলে।
এই আবরণটি দেখতে চকচকে সাদা, তাই আমরা সাধারণত তরুণাস্থিকে সাদা, নীলভি এবং
চকচকে দেখতে পাই। আমাদের দেহে কয়েক রকম তরুণাস্থি আছে (যেমন কানের পিনার
তরুণাস্থি)। তরুণাস্থি বিভিন্ন অস্থির সংযােগস্থলে, কিংবা অস্থির কিছু অংশে
উপস্থিত থাকে।
| একক কাজ
কাজ: অস্থি ও তরুণাস্থির মধ্যে পার্থক্য কর।
অস্থিসন্ধি (Bonejoint বা Joint) | দুই বা ততােধিক অস্থির সংযােগস্থলকে
অস্থিসন্ধি বলে। প্রতিটি অস্থিসন্ধির অস্থিগুলাে একরকম | স্থিতিস্থাপক
রঙ্গুর মতাে বন্ধনী দিয়ে দৃঢ়ভাবে আটকানাে থাকে, ফলে অস্থিগুলাে সহজে
সন্ধিস্থল
থেকে বিচ্যুত হতে পারে না। সন্ধিস্থল বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সঞ্চালনে
সাহায্য করে।
আমাদের শরীরে সব অস্থিসন্ধি এক রকম নয়। এদের কোনােটি একেবারে অনড়, যেমন
আন্তঃকশেরুকীয় অস্থিসন্ধি, কোনােটি আবার সহজে সঞ্চালন করা যায়, যেমন হাত
এবং পায়ের অস্থিসন্ধি।
সাইনােভিয়াল অস্থিসন্ধি (synovial Joint): | একটি অস্থিসন্ধিতে দুটি মাত্র
অস্থির বহির্ভাগে এসে মিলিত হয়ে একটি সরল সাইনােভিয়াল অস্থিসন্ধি গঠন
করে। আর যখন দুয়ের অধিক অস্থি মিলিত হয়, তখন একে জটিল সাইনােভিয়াল
অস্থিসন্ধি বলে। সাইনােভিয়াল অস্থিসন্ধির অংশগুলাে হলাে: তরুণাস্থিতে আবৃত
অস্থিপ্রান্ত, সাইনােভিয়াল রস (Synovial fluid) এবং অস্থিসন্ধিকে
দৃঢ়ভাবে আটকে রাখার জন্য অস্থিবন্ধনী বা লিগামেন্ট
বেষ্টিত একটি মজবুত আবরণী বা ক্যাপসুল। অস্থিসন্ধিতে সাইনােভিয়াল রস এবং
তরুণাস্থি থাকাতে অস্থিতে অস্থিতে ঘর্ষণ এবং তজ্জনিত ক্ষয় হ্রাস পায় ও
অস্থিসদ্ধি নড়াচড়া করাতে কম শক্তি ব্যয় হয়। অস্থিসন্ধি কয়েক ধরনের।
যেমন: (a) নিশ্চল অস্থিসন্ধি (Fixed Joint): নিশ্চল অস্থিসন্ধিগুলাে অনড়,
অর্থাৎ এগুলাে নাড়ানাে যায় না, যেমন করােটিকা অস্থিসন্ধি। | (b) ঈষৎ সচল
অস্থিসন্ধি (slightly movable Joint): এসব অস্থিসন্ধি একে অন্যের সাথে।
সংযুক্ত থাকলেও সামান্য নাড়াচাড়া করতে পারে, ফলে আমরা দেহকে সামনে, পিছনে
এবং পাশে বাঁকাতে পারি। যেমন মেরুদণ্ডের অস্থিসন্ধি। (c) পূর্ণ সচল
অস্থিসন্ধি (Freely movable joint): এ সকল অস্থিসন্ধি সহজে নড়াচড়া করানাে
যায়। এ জাতীয় অস্থিসন্ধির মধ্যে বল ও কোটরসন্ধি, কবজাসন্ধি প্রধান।
সাইনােভিয়াল অস্থিসন্ধিই কেবল পূর্ণ সচল হতে পারে। (i) বল ও কোটরসন্ধি
(Ball & Socket Joint): বল ও কোটরসন্ধিতে সন্ধিস্থলে একটি অস্থির মাথার
মতাে গােল অংশ অন্য
অস্থির কোটরে এমনভাবে স্থপিত থাকে যেন অস্থিটি বাঁকানাে, পাশে চালনা করা
কিংবা সকল দিকে নাড়ানাে সম্ভবপর হয়। এটি এক ধরনের সাইনােভিয়াল
অস্থিসন্ধি। উদাহরণ: কাঁধ এবং উরুসন্ধি। (ii) কজা সখি (HInge Joint): কজা
যেমন দরজার পাল্লাকে কাঠামাের সাথে আটকে রাখে, সেরুপ কজার মতাে সন্ধিকে কজা
সন্ধি বলে। যেমন: হাতের কনুই, জানু এবং আঙুলগুলিতে এ ধরনের সন্দি দেখা
যায়। এসব সন্ধি কেবল এক দিকে নাড়ানাে যায়। এগুলােও সাইনােভিয়াল
অস্থিসন্ধির উদাহরণ।
। একক কাজ
কাজ: মানবকঙ্কালের চিত্র অঙ্কন করে বিভিন্ন অংশ চিহ্নিত কর।
9.2 পেশি
| তােমরা সপ্তম শ্রেণিতে বিভিন্ন পেশি সম্পর্কে জেনেছ। অভ্যন্তরীণ অঙ্গ এবং
রক্তনালির গায়ের অনৈচ্ছিক
পেশি, হৃৎপিণ্ডের হৃৎপেশি এবং অস্থিগাত্রের সাথে লাগানাে ঐচ্ছিক কঙ্কাল
পেশি নিয়ে পেশিতন্ত্র | গঠিত। পেশিত বিভিন্ন ধরনের গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে
থাকে। যেমন: • অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সঞ্চালন, চলাফেরায় সহায়তা, অঙ্গবিন্যাস এবং
ভারসাম্য রক্ষা করা। • কঙ্কালতলের সাথে যৌথভাবে দেহের নির্দিষ্ট আকার গঠন
করা।
পেশিতে গ্লাইকোজেন সঞ্চয় করে ভবিষ্যৎ জরুরি প্রয়ােজনে শক্তির উৎস হিসেবে
ব্যবহার করা। • বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হওয়ায় হৃৎপেশির হৃৎপিণ্ডের
স্পন্দন এবং রক্ত সঞ্চালনের দায়িত্ব পালন করা। • মলমূত্র ত্যাগ,
পরিপাকনালির মধ্য দিয়ে খাদ্যবস্তুর চলন প্রভৃতি স্বয়ংক্রিয় কাজে ভূমিকা
পালন। 9.2.1 মানুষের চলনে অস্থি ও পেশির ভূমিকা মানুষের চলনে অস্থি ও পেশির
ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। অস্থি দেহের কাঠামাে কঙ্কাল গঠন করে, আর
পেশিতন্ত্র এই কাঠামাের উপর আচ্ছাদন তৈরি করে। ঐচ্ছিক পেশি টেন্ডন নামক
দৃঢ় এবং স্থিতিস্থাপক | এক ধরনের পেশি দিয়ে অস্থিকে আটকে রাখে।
স্নায়ুবিক উত্তেজনা পেশির মধ্যে উদ্দীপনা জাগানাের ফলে পেশি সংকুচিত হয়
আবার উদ্দীপনা সরিয়ে দিলে পেশি পুনরায় শিথিল বা প্রসারিত হয়। এই সংকোচন
এবং প্রসারণের সাহায্যে সংলগ্ন অস্থির নড়াচড়া সম্ভব হয়। এভাবে পেশি
কোনাে অঙ্গকে
প্রসারিত করে, কোনাে অগকে ভাঁজ করে, কোনাে অঙ্গকে উপরের দিকে উঠায়, কোনাে
অঙ্গকে নিচে নামায় বা কোনাে অঙ্গকে প্রধান অক্ষের চারপাশে, ডানে-বাঁয়ে
ঘােরায়। একটি উদাহরণ দিয়ে পেশির কার্যক্রম ব্যাখ্যা করা যায়। কনুই বাঁকা
বা সােজা করতে হলে ঐচ্ছিক পেশি কীভাবে কাজ করে সেটি লক্ষ কর। কনুই বাঁকা
করতে হলে ইচ্ছাধীন স্নায়ুর তাড়নায় বাইসেপস পেশি সংকুচিত হয় এবং
ট্রাইসেপস পেশি শিথিল হয়ে প্রসারিত হয়। ফলে রেডিয়াস ও আলনাকে হিউমেরাসের
কাছে নিয়ে আসে। কনুই সােজা করতে হলে ঠিক তার বিপরীত কার্যক্রমটি ঘটে,
অর্থাৎ ইচ্ছাধীন সামুর তাড়নায় ট্রাইসেস পেশি সংকুচিত হয় এবং রেডিয়াস
এবং আপনাকে টেনে সােজা করে। হিউমেরাসের সাথে প্রায় এক সরলরেখায় নিয়ে
আসে। এ সময় বাইসেপস পেশি শিথিল হয়ে প্রসারিত হয়। এভাবে বাইসেপস এবং
ট্রাইসেপস পেশির সংকোচন এবং শ্লথ হওয়ার মাধ্যমে আমরা কনুই ভাঁজ করতে আর
খুলতে পারি। এভাবে দেহের বিভিন্ন পেশি কার্যক্রমের মাধ্যমে বিভিন্ন অঙ্গের
সঞ্চালন ঘটে।
9.2.2 টেনডন (Tendon) ও লিগামেন্ট বা অস্থিবন্ধনী (Ligament)। আমরা
তােমাদের যখন বলি পেশি হাড়ের সাথে আটকে থাকে অথবা একটি হাড়ের সাথে অন্য
হাড় বন্ধনীর সাহায্যে আটকে থাকে, তখন সেটি কীভাবে ঘটে তা নিয়ে তােমাদের
নিশ্চয় কৌতূহল হয়। মাংসপেশির প্রান্তভাগ দড়ি বা রজ্জর মতাে শক্ত হয়ে
অস্থির গায়ের সাথে সংযুক্ত হয়। এই শন্তু প্রান্তকে টেনডন বলে। টেনডন ঘন,
শ্বেত তন্তুময় যােজক টিস্যু দিয়ে গঠিত। এ ধরনের টিস্যুর অন্তঃকোষীয়
পদার্থ বা ম্যাট্রিক্সে শাখা-প্রশাখাবিহীন শ্বেততন্তু ছড়ানাে থাকে। এরা
গুচ্ছাকারে এবং পরস্পর সমান্তরালভাবে বিন্যস্ত থাকে। অনেকগুলাে তন্তু
একত্রে আঁটি বা বান্ডিল তৈরি করে। আঁটিগুলাে একত্রে দলবদ্ধ হয়ে আঁটিগুচ্ছ
তৈরি করে। আঁটিগুচ্ছগুলাে আবার তন্ময় টিস্যুগুচ্ছ বা অ্যারিওলার টিস্যু
দিয়ে বেষ্টিত হয়ে আরাে বড় অটিতে শ্রেণিবদ্ধ হয়। অ্যারিওলার টিস্যুর
দৈর্ঘ্য বরাবর টেনডনের মধ্যে রক্তনালি, লসিকানালি এবং স্নায়ু প্রবেশ করে।
টেনডনের স্থিতিস্থাপকতা তুলনামূলকভাবে বেশ কম।
পেশি এবং টেনডনের সংযােগস্থলে টেনন তন্তুগুলাে পেশিতন্তুর সারকোলেমায়
সংযােজিত হয়। পেশি এবং টেনডনের সংযােগকে আরও শক্তিশালী করার জন্য টেনডনের
আঁটিগুচ্ছ বেষ্টনকারী অ্যারিওলার টিস্যু, পেশি বান্ডিল বা আঁটির আবরক
টিস্যুর সাথে অবিচ্ছিন্ন যােগাযােগ তৈরি করে । টেনডন বেশ শক্ত। অস্থি বা
পেশির তুলনায় টেনডনের ভেঙে বা ছিড়ে যাওয়ার সম্ভবনা অনেক কম, তবে
কোনােভাবে যদি তা ছিড়ে যায়, তাহলে সহজে জোড়া লাগে না। পেশিবন্ধনী
পেশিপ্রান্তে রজ্জর মতাে শক্ত হয়ে অস্থির সাথে সংযুক্ত থাকে। পেশি অস্থির
সাথে আবদ্ধ হয়ে দেহকাঠামাে গঠনে, দৃঢ়তা দানে, অস্থিবন্ধনী গঠনে সাহায্য
করে এবং চাপটানের (tensile strength) বিরূদ্ধে যান্ত্রিক প্রতিরােধ গড়ে
তােলে।
পাতলা কাপড়ের মতাে কোমল অথচ দৃঢ়, স্থিতিস্থাপক যে বন্ধনী দিয়ে
অস্থিগুলাে
পরস্পরের সাথে সংযুক্ত থাকে তাকে অস্থিবন্ধনী | বা লিগামেন্ট বলে।
লিগামেন্ট শ্বেততন্দু এবং পীততন্তু এই দুই ধরনের ইলাস্টিক তন্তু দিয়ে
গঠিত। এতে পীতবর্ণের স্থিতিস্থাপক তন্তুর সংখ্যা বেশি থাকে। এর মধ্যে সরু,
শাখা-প্রশাখা বিশিষ্ট জালাকারে বিন্যস্ত কতগুলো তন্তুও ছড়ানাে থাকে। এ
তন্তুগুলাে গুচ্ছাকারে না
থেকে আলাদাভাবে অবস্থান কর। এদের স্থিতিস্থাপকতা তুলনামূলকভাবে বেশি।
ইলাস্টিক তন্তুগুলাে। ইলাস্টিন নামক প্রােটিন দিয়ে তৈরি। কজা যেমন
পাল্লাকে দরজার কাঠামাের সাথে আটকে রাখে। একইভাবে অস্থিবন্ধনী বা লিগামেন্ট
হাড়কে আটকে রাখে। এতে অঙ্গটি সবদিকে সােজা বা বাঁকা হয়ে। নড়াচড়া করতে
পারে এবং হাড়গুলি স্থানচ্যুত ও বিচ্যুত হয় না।
একক কাজ
কাজ: ছকটি খাতায় আঁক ও পূরণ কর।
বৈশিষ্ট্য | টেনডন গঠন
লিগামেন্ট
কাজ
স্থিতিস্থাপকতা
9.3 অস্থিসংক্রান্ত রােগ।
(a) অস্টিওপােরােসিস (Osteoporosis) তােমরা আগে জেনেছ, অস্থির গঠন এবং
দৃঢ়তার জন্য ক্যালসিয়াম একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। অস্থির বৃদ্ধির জন্য
চাই ভিটামিন এবং ক্যালসিয়াম-সমৃদ্ধ খাদ্য। অস্টিওপােরােসিস ক্যালসিয়ামের
অভাবজনিত একটি রােগ। বয়স্ক পুরুষ ও নারীদের সাধারণত এ রােগটি হয়। যেসব
বয়স্ক পুরুষ বহুদিন যাবৎ স্টেরয়েডযুক্ত ঔষধ সেবন করেন, তাদের ও নারীদের
মেনােপজ (রজ-নিবৃত্তি, অর্থাৎ মাসিক চিরতরে বন্ধ হয়ে যাওয়া) হওয়ার পর এ
রােগ হওয়ার আশঙ্কা বেশি। যারা অলস জীবন যাপন করেন কিংবা কায়িক পরিশ্রম কম
করেন, তাদেরও এ রােগ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাছাড়া অনেক দিন ধরে
অথ্রিাইটিসে (অস্থিসন্ধির প্রদাহ) ভুগলে এ রােগ হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি
হয়। কারণ: দেহে খনিজ লবণ বিশেষ করে ক্যালসিয়ামের ঘাটতির কারণে এ রােগটি
হয়। নারীদের মেনােপজ হওয়ার পর অস্থির ঘনত্ব এবং পুরুত্ব কমতে থাকে।
লক্ষণ • অস্থি ভঙ্গুর হয়ে যায়, ঘনত্ব কমতে থাকে, • পেশির শক্তি কমতে
থাকে, • পিঠের পিছন দিকে ব্যথা অনুভব হয়, • অস্থিতে ব্যথা অনুভব হয়।
রােগ নির্ণয় ঘনত্বমাপক যন্ত্রের সাহায্যে অস্থির খনিজ পদার্থের এ রােগ
নির্ণয় করা হয়। রােগের প্রাথমিক অবস্থায় তেমন কোনাে উপসর্গ দেখা দেয়
না। হঠাৎ করেই সামান্য আঘাতে কোমর বা দেহের অন্যান্য কোনাে অঙ্গের হাড়
ভেঙ্গে যায়।
প্রতিকার • পঞ্চাশাের্ধ পুরুষ ও নারীদের দৈনিক 1200 মিলিগ্রাম (বা চিকিৎসক
নির্দেশিত অন্য কোনাে পরিমাণ)
ক্যালসিয়াম গ্রহণ করা। • ননিতােলা দুধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্য গ্রহণ করা। •
কমলার রস, সবুজ শাকসবজি, সয়াদ্রব্য ও ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া।
প্রতিরোধ • যথেষ্ট পরিমাণে সূর্যালােকের সংস্পর্শে আসা।
• ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ করা। • নিয়মিত ব্যায়াম
করা (যদি কেউ ইতােমধ্যে অস্টিওপােরােসিসে আক্রান্ত হয় তাহলে ব্যায়াম
করার।
আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে)।
• সুষম ও আঁশযুক্ত খাবার গ্রহণ করা।
(b) রিউমাটয়েড আথ্রাইটিস বা গেঁটেবাত (Rheumatoid Arthritis) শতাধিক
প্রকারের বাতরােগের মধ্যে রিউমাটয়েড আর্থাইটিস অন্যতম। সাধারণত বয়স্করা এ
রােগে আক্রান্ত হয়। কম বয়সী ছেলেমেয়েদের বেলায় গিটে ব্যথা বা যন্ত্রণা
হওয়া রিউমেটিক ফিভার বা বাতজ্বর (rheumatic fever) জাতীয় অন্য রােগের
লক্ষণ হতে পারে (ষষ্ঠ অধ্যায় দ্রষ্টব্য)। অস্থিসন্ধির অসুখের প্রকারভেদ
অনুসারে চিকিৎসার পার্থক্য হয়। দুইজন ব্যক্তি দুটি ভিন্ন প্রকারের
অস্থিসন্ধির অসুখে আক্রান্ত হলেও তাদের লক্ষণ আপাতদৃষ্টিতে একইরকম হতে
পারে। সেক্ষেত্রে দুইজনের ভিন্ন প্রকারের চিকিৎসা প্রয়ােজন। এজন্য
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ ছাড়া বাতের চিকিৎসা করা। উচিত নয়। এতে
উপকারের চেয়ে অপকার বেশি হতে পারে।
লক্ষণ
• অস্থিসন্ধি বা গিটে প্রদাহ বা ব্যথা হয়
• অস্থিসন্ধিগুলাে শক্ত হয়ে যায়
• অস্থিসন্ধি নাড়াতে কষ্ট হয়।
• গিট ফুলে যায়।
প্রতিকার বয়স্কদের বেলায় এ রােগ পুরােপুরি সারানাে যায় না। তবে নিচের
ব্যবস্থাগুলাে নিলে কিছুটা উপশম
• অত্যধিক পরিশ্রম আর ভারী কাজ থেকে বিরত থাকা।
• যন্ত্রণাদায়ক গিটের উপর কুসুম গরম সাঁক নেওয়া।
• অস্থিসন্ধির নড়াচড়া ঠিক রাখতে হালকা ব্যায়াম করা।
ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী বেদনা উপশমকারী ঔষধ সেবন ও সঠিক চিকিৎসা দিয়ে এ
রােগের কষ্ট। থেকে আংশিক পরিত্রাণ পাওয়া যায়।
প্রতিরােধ • চিকিৎসক নির্দেশিত পদ্ধতিতে নিয়মিত ব্যায়াম করা। • সুষম ও
আঁশযুক্ত খাদ্য গ্রহণ করা।
একক কাজ
কাজ: তােমার এলাকায় পঞ্চাশাের্ধ মহিলাদের জীবনধারা, খাদ্যগ্রহণের তথ্য
সংগ্রহ কর। তাদের। মধ্যে অস্টিওপােরােসিস ও আথ্রাইটিস এর কারণ অনুসন্ধান
করে লিপিবদ্ধ কর।
2) অনুশীলনী
| (৫ ) সংক্ষিপ্ত উত্তর প্রশ্ন
1. অস্থিসন্ধি কাকে বলে। 2. কঙ্কালের পাঁচটি কাজ উল্লেখ কর। 3. টেনডন ও
লিগামেন্টের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় কর। 4. সাইনােভিয়াল সন্ধির বৈশিষ্ট্য
কী? 5. অস্থি ও তরুণাস্থির মধ্যে পার্থক্য উল্লেখ কর।
(3) রচনামূলক প্রশ্ন
_1. অস্টিওপােরােসিসের কারণ ও লক্ষণগুলাে লেখ।
ক) বহুনির্বাচনি প্রশ্ন
1. কোনটি অস্থির বৈশিষ্ট্য?
ক, স্থিতিস্থাপক খ. তন্তুময়
গ. দৃঢ় ঘ, নরম 2. টেনডনের টিস্যু হচ্ছে
i. সাদা বর্ণের ও উজ্জ্বল ii. অশখি ও তরঙ্গিত। ii. তন্তুময় ও গুচ্ছাকার
নিচের কোনটি সঠিক? ক. i ও ii খ. i ও iii গ. ii ও iii ঘ. i, ii ও iii
উদ্দীপকটি পড়ে 3 ও 4 নং প্রশ্নের উত্তর দাও। 60 বছরের রহিমা বেগম
হাত-পায়ের ব্যথার জন্য তেমন কাজ করতে পারেন না। চিকিৎসক বলেছেন। তার শরীরে
ক্যালসিয়ামের অভাবে অস্টিওপােরােসিস রােগ হয়েছে। 3. রহিমা বেগমের উত্ত
রোগের লক্ষণ কোনটি? | ক, অস্থির পুরুত্ব বেড়ে যাওয়া খ, অস্থি ভর হয়ে
যাওয়া
গ. কোমরে ব্যথা অনুভব করা ঘ. পেশিশক্তি বাড়তে থাকা
এ. রহিমা বেগমের উৰ রােগটি প্রতিরােধের উপায় হচ্ছে—
i. রাফেজযুক্ত খাবার খাওয়া ii. অলসময় জীবন পরিহার করা iii. ভিটামিন ডি
যুৱ খাদ্য কম খাওয়া
নিচের কোনটি সঠিক? ক. i ও ii খ. i ও iii গ. ii ও iii ঘ. i, ii ও iii
সৃজনশীল প্রশ্ন
i. 12 বছরের বিনিতা বেশ স্বাস্থ্যবতী এবং চঞ্চল প্রকৃতির। সে তার সারা
দিনের কার্যক্রমের
অনেকটা সময় দৌড়ঝাঁপ, খেলাধুলা করে কাটায়। একদিন সে দৌড়াতে গিয়ে পড়ে
গেলে পায়ের | লিগামেন্টে আঘাত পায়।
ক, অস্থি কী?
খ. গেঁটেবাত বলতে কী বােঝায়?
গ, বিনিতাৱ আঘাতপ্রাপ্ত অংশটি দরজার কার সাথে তুলনা করা হয় কেন? ব্যাখ্যা
কর।
ঘ, বিনিতার কার্যক্রমটি সম্পন্ন করতে কীসের সমম্বয় অপরিহার্য বিশ্লেষণ কর।
ক, টেনডন কী?
খ. অস্টিওপােরােসিস বলতে কী বােঝায়?
গ. চিত্রে দেহের X অংশটির কোষের গঠন ভিন্ন কেন? ব্যাখ্যা কর।
ঘ. চিত্রে X ও Y উভয়ের সমন্বিত কার্যক্রম কীভাবে অঙ্গ সঞ্চালনে ভূমিকা
রাখে? বিশ্লেষণ কর।
▣ প্রধান শব্দভিত্তিক সারসংক্ষেপ
♦ জীববৈচিত্র্য : জীবের জিনগত, প্রজাতিগত ও পরিবেশগত বৈচিত্র্যকে একসঙ্গে জীববৈচিত্র্য বলা হয়।