মাধ্যমিক জীববিজ্ঞান (SSC Biology)

দশম অধ্যায় : সমন্বয়

what image shows
আমরা জানি, জীবদেহে শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়া বিক্রিয়া অবিরামভাবে চলছে। এ কাজগুলাে একযােগে চলে বলে এ কাজগুলাের মধ্যে সমন্বয় (co-ordination) একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপের মধ্যে সমম্বয় না থাকলে জীবের জীবনে নানারকমের অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়। উদ্ভিদদেহের বিভিন্ন কাজ যেমন; প্রজনন, সুস্থাবস্থা, অঙ্কুরােদগম, বিপাক, বুদ্ধি, চলন ইত্যাদি সকল শারীরবৃধীয় ক্রিয়ার মধ্যে একধরনের সময় লক্ষ করা যায়। মানবদেহেও তেমনি বিভিন্ন কাজের মধ্যে সময় রয়েছে। উদাহরণ দেওয়ার জন্য স্নায়ুতন্ত্র এবং হরমােনের সমন্বয়ের কথা বলা যায়। এ অধ্যায়ে উদ্ভিদ ও মানবদেহের সংঘটিত বিভিন্ন সমন্বয় প্রক্রিয়া সম্পর্কে আলােচনা করা হয়েছে।

এই অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা:

♦  উদ্ভিদের সমন্বয় প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করতে পারব।
♦  প্রাণীর সমন্বয় প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করতে পারব।
♦  স্নায়ুতন্ত্রের প্রধান অংশসমূহের কাজ ব্যাখ্যা করতে পারব।
♦  সাধারণ নিউরনের গঠন ও কাজ ব্যাখ্যা করতে পারব।
♦  প্রতিবর্তী প্রতিক্রিয়া ব্যাখ্যা করতে পারব।
♦  আবেগ সঞ্চালন প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করতে পারব।
♦  প্রাণরস বা হরমােনের প্রধান কাজ ব্যাখ্যা করতে পারব।
♦  প্রাণরস বা হরমােনের অস্বাভাবিকতার কারণ ও এটি থেকে সৃষ্ট প্রধান শারীরিক সমস্যাগুলাে বর্ণনা করতে পারব।
♦  স্ট্রোকের কারণ ও লক্ষণ বর্ণনা করতে পারব।
♦  স্ট্রোকে তাৎক্ষণিক করণীয় ও প্রতিরোধের উপায় বর্ণনা করতে পারব।
♦  স্নায়বিক বৈকল্যজনিত শারীরিক সমস্যার লক্ষণ, কারণ ও প্রতিকার বর্ণনা করতে পারব।
♦  সমন্বয় কার্যক্রমে তামাক ও মাদকদ্রব্যের প্রভাব বিশ্লেষণ করতে পারব।
♦  হরমােনজনিত শারীরিক সমস্যা সৃষ্টির কারণ অনুসন্ধান করতে পারব।
♦  পােস্টার/লিফলেট অঙ্কন করে তামাক ও মাদক দ্রব্যের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করতে পারব।
♦  স্নায়ুতন্ত্রে তামাক ও মাদক দ্রব্যের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সচেতন হব।

10.1 উদ্ভিদে সমন্বয়

প্রাণীর মতাে উদ্ভিদের প্রতিটি কোষেও বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় কার্যক্রম একযােগে এবং প্রতিনিয়ত চলতে থাকে। এ কাজগুলাে একটি নিয়মশৃঙ্খলার মাধ্যমে সংঘটিত হয়, এ কারণে উদ্ভিদ জীবনে বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় কর্মকাণ্ডের সমন্বয় (co-ordination) অপরিহার্য। এ সমম্বয় না থাকলে উদ্ভিদ জীবনে বিভিন্ন রকমের অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়। একটি উদ্ভিদের জীবনকালে সময়ের সাথে সামঞ্জস্য রেখে জীবনচক্রের পর্যায়গুলাে, যেমন অঙ্কুরােদগম, বৃদ্ধি ও বিকাশ, পুষ্পায়ন, ফল সৃষ্টি, পূর্ণতা, সুপ্তাবস্থা ইত্যাদি একটি সুশৃঙ্খল নিয়ম মেনে চলে। এসব কাজে আবহাওয়া এবং জলবায়ুজনিত প্রভাবকগুলাের গুরুত্বও লক্ষ করার মতাে। উদ্ভিদের বৃদ্ধি এবং চলনসহ বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় কাজগুলাে প্রকৃতপক্ষে অত্যন্ত জটিল এবং চলমান। তা সত্ত্বেও এ কাজ অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে বিশেষ নিয়ম মেনে সম্পন্ন হয়, একটি কাজ কোনােভাবেই অন্য কাজকে বাধা প্রদান করে না। লক্ষ কোটি বছরের বিবর্তনের মাধ্যমে এমন সুক্ষ্ম সমন্বয় অর্জিত হয়েছে।

10.1.1 ফাইটোহরমােন

যে জৈব রাসায়নিক পদার্থ উদ্ভিদদেহে উৎপন্ন হয়ে উদ্ভিদের বৃদ্ধি এবং বিকাশ, বিভিন্ন অঙ্গ সৃষ্টি ইত্যাদি কাজ নিয়ন্ত্রণ করে, তাকে হরমােন বা প্রাণরস বলে। উদ্ভিদ হরমােনকে ফাইটোহরমােন (Phytohormones) বলা হয়। কেউ কেউ ফাইটোহরমােনকে উদ্ভিদ বৃদ্ধিকারক বস্তু (Plant growth substances) হিসেবেও আখ্যায়িত করেছেন। অধিকাংশ বিজ্ঞানীদের মতে, যে রাসায়নিক বস্তুটি কোষে উৎপন্ন হয় এবং উৎপত্তিস্থল থেকে বাহিত হয়ে দূরবর্তী স্থানের কোষ বা কোষপুঞ্জের কার্যাবলি নিয়ন্ত্ৰণ করে, সেটাই হচ্ছে হরমােন (Hormone)। উদ্ভিদের প্রতিটি কোষই হরমােন উৎপন্ন করতে পারে। এরা কোনাে পুষ্টিদ্রব্য নয় তবে ক্ষুদ্রমাত্রায় উৎপন্ন হয়ে উদ্ভিদের বিভিন্ন জৈবিক কাজ নিয়ন্ত্রণ করে। যেমন: অক্সিন (Auxin), জিবেরেলিন (Gibberellin), সাইটোকাইনিন (Cytokinin), অ্যাবসিসিক এসিড (Abscisic acid), ইথিলিন (Ethylene) ইত্যাদি। উল্লিখিত এসব হরমােন ছাড়াও উদ্ভিদে আরও কিছু হরমােন রয়েছে, যাদের আলাদা করা বা শনাক্ত করা যায়নি। এদের পসটুলেটেড হরমােন (Postulated horrones) বলে। এরা প্রধানত উদ্ভিদের ফুল ও জনন সংশ্লিষ্ট অঙ্গের বিকাশে সাহায্য করে। এদের মধ্যে ফ্লোরিজেন (Florigen) এবং ভার্নালিন (Vermalin) প্রধান। ধারণা করা হয়, ফ্লোরিজেন পাতায় উৎপন্ন হয় এবং তা পত্রমূলে স্থানান্তরিত হয়ে পত্রমুকুলকে পুষ্পমুকুলে রূপান্তরিত করে। তাই দেখা যায়, ফ্লোরিজেন উদ্ভিদে ফুল ফোটাতে সাহায্য করে। নিচে প্রধান ফাইটোহরমােনগুলাে সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলােচনা করা হলাে।

(a) অক্সিন:

চার্লস ডারউইন এ হরমােন প্রথম আবিষ্কার করেন। যাকে কোল (Kogl) এবং হ্যাঁগেন স্নিট। (Haagen Snit) পরবর্তীতে অক্সিন নামে অভিহিত করেন। চার্লস ডারউইন উদ্ভিদের জ্বণমুকুলীবরণীর (Coleoptiles) উপর আলাের প্রভাব লক্ষ করেন। যখন আলাে বাঁকাভাবে একদিকে লাগে, তখন ভুণমুকুলাবণী আলাের উৎসের দিকে বেঁকে যায়। অথচ অন্ধকারে এটি খাড়াভাবে বৃদ্ধি পায়। বিজ্ঞানীরা। পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হন যে জ্বণণমুকুলবরণীর অগ্রভাগে অবস্থিত এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ এর জন্য দায়ী। ঐ পদার্থটি অক্সিন নামক হরমােন। অক্সিন প্রয়ােগ করা হলে শাখা কলমে মূল গজায় এবং অকালে ফলের ঝরে পড়া বন্ধ হয়। উদ্ভিদকোষে অক্সিনের পরিবহন নিম্নমুখীভাবে হয়। অক্সিনের প্রভাবে অভিস্রবণ এবং শ্বসন ক্লিয়ার হার বেড়ে যায়। বীজহীন ফল উৎপাদনেও এর ব্যবহার রয়েছে।

(b) জিবেরেলিন:

ধানের বাকানি (Bakanae) রােগের জীবাণু এক ধরনের ছত্রাক যা ধানগাছের অতিবৃদ্ধি ঘটায়। এই | ছত্রাক থেকে এক ধরনের জৈব রাসায়নিক পদার্থ নিষ্কাশিত হয়, যার প্রভাবে এরকম অতিবৃদ্ধি হয়ে। থাকে। এই পদার্থটি জিবেরেলিন। অধিকাংশ জিবেরেলিন উদ্ভিদের পাকা বীজে থাকে, তবে চারাগাছ, বীজপত্র এবং পলের বর্ধিষ্ণু অঞ্চলেও এটি দেখা যায়। এর প্রভাবে উদ্ভিদের পর্বমধ্যগুলাে দৈর্ঘ্যে বেড়ে যায়, যার কারণে উদ্ভিদ কাণ্ডের অতিবৃদ্ধি ঘটে। এ জন্য খাটো উদ্ভিদে এই হরমােন প্রয়ােগ করলে উদ্ভিদটি অন্যান্য সাধারণ উদ্ভিদ থেকেও অধিক লম্বা হয়ে যায়। ফুল ফোটাতে, বীজের সুপ্তাবস্থার দৈর্ঘ্য কমাতে এবং অঙ্কুরােদগমে এর কার্যকারিতা রয়েছে।

(c) সাইটোকাইনিন:

এই ফাইটোহরমােন বা উদ্ভিদ হরমােনটি ফল, শস্য এবং ডাবের পানিতে পাওয়া যায়। কোনাে কোনাে উদ্ভিদের মূলেও এদের পাওয়া যায়। সাধারণভাবে এটি বিভিন্ন ঘনত্বে অক্সিনের সাথে যুক্ত | হয়ে কোষ বিভাজনকে উদ্দীপিত করে। এছাড়া কোষবৃদ্ধি, অঙ্গের বিকাশসাধন, বীজ এবং অন্সের সুপ্তাবস্থা ভঙ্গকরণে ও বার্ধক্য বিলম্বিতকরণে এ হরমােন ভূমিকা পালন করে। কোষ বিভাজনের সময়। সাইটোকাইনিন হরমােনের প্রভাবে কোষের সাইটোকাইনেসিস ঘটে।

(d) ইথিলিন:

এ হরমােনটি একটি গ্যাসীয় পদার্থ। এটি ফল পাকাতে সাহায্য করে। এই হরমােন ফল, ফুল, বীজ, পাতা এবং মূলেও দেখা যায়। ইথিলিন বীজ এবং মুকুলের সুপ্তাবস্থা ভঙ্গ করে, চারা গাছের কাণ্ডের | বৃদ্ধি ঘটিয়ে চারা গাছকে লম্বা হতে সাহায্য করে, ফুল এবং ফল সৃষ্টির সূচনা করে। ইথিলিন পাতা, ফুল এবং ফলের ঝরে পড়া ত্বরান্বিত করে। কৃত্রিম উপায়ে ফল পাকাতেও এর ব্যবহার রয়েছে।

হরমােনের ব্যবহার:

অক্সিন ও অন্যান্য কৃত্রিম হরমােন শাখাকলমে মূল উৎপাদনে সাহায্য করে। ইন্ডােল অ্যাসিটিক এসিড। (IAA) নামক এক ধরনের অক্সিনের প্রভাবে ক্যাম্বিয়ামের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়। ফলে ক্যালসি নামক (callus) এক ধরনের অনিয়ন্ত্রিত কোষগুচ্ছের সৃষ্টি হয় এবং ক্ষতস্থান পূরণ হয়। অক্সিন প্রয়োগ করে ফলের মােচল বিলম্বিত করা হয়। বীজহীন ফল উৎপাদনে অক্সিন ও জিবেরেলিনের ব্যবহার রয়েছে। বৃদ্ধি (Growth): উদ্ভিদের বিভিন্ন অঙ্গ বিকাশের ক্ষেত্রে আলাে এবং উষ্ণতার প্রভাব লক্ষণীয়। এর ফলে বিভিন্ন সংশ্লেষণ। পদ্ধতির মাধ্যমে বিভিন্ন উপাদান উৎপন্ন হয়ে নতুন অঙ্গের সৃষ্টি করে। আলোর উপস্থিতিতে সম্ভবত অক্সিন হরমােন নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় ফলে অন্ধকারের দিকে অক্সিনের ঘনত্ব বাড়ে। বিজ্ঞানীদের মতে, আলাের দিকে থাকা অক্সিন অন্ধকার দিকে চলে যায়, ফলে সেদিকে বৃদ্ধি বেশি হয় এবং আলােকিত অংশের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়, কাজেই উদ্ভিদটি আলাের দিকে বেঁকে বৃদ্ধি পায়। দৃণমূল বা ভ্রণকাণ্ডের অগ্রাংশ অভিকর্ষের উদ্দীপনা অনুভব করতে পারে। একে অভিকর্ষ উপলদ্ধি (Geoperception) বলে। অভিকর্ষণের ফলে কোষের উপাদানগুলাে নিচের দিকে স্থানান্তরিত হয়। এদের চাপ পড়ে পার্শ্বীয় কোষের প্রাচীরে। এর ফলে অভিকর্ষণীয় চলন দেখা যায়। অনেক উদ্ভিদের পুষ্প প্রস্ফুটন দিনের দৈর্ঘ্যের উপর অধিক নির্ভরশীল। যেমন চন্দ্রমল্লিকা একটি ছােটদিনের উদ্ভিদ। দীর্ঘ আলােক ঐসব উদ্ভিদে পুষ্প উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটায়। উদ্ভিদে আলাে-অন্ধকারের এ ছন্দ এক ধরনের জৈবিক ঘড়ি (biological clock)-এর উদাহরণ। উদ্ভিদের আলাে-অন্ধকারের ছন্দের উপর ভিত্তি করে পুস্পধারী উদ্ভিদকে তিন ভাগে করা হয়: (a) ছােটদিনের উদ্ভিদ (Short Day Plant): পুস্পায়নে দৈনিক গড়ে ৪-12 ঘণ্টা আলাে প্রয়োজন। যেমন; চন্দ্রমল্লিকা, ডালিয়া। (b) বড়দিনের উদ্ভিদ (Long Day Plant): পুষ্পায়নে দৈনিক গড়ে 12-16 ঘণ্টা আলাে প্রয়ােজন। যেমন: লেটুস, ঝিঙা। (c) আলােক নিরপেক্ষ উদ্ভিদ (Day Neutral Plant): পুস্পায়নে দিনের আলাে কোনাে প্রভাব ফেলে না। যেমন: শসা, সূর্যমুখী। উদ্ভিদের বৃদ্ধি এবং পুস্পায়নে আলাের মতাে তাপ এবং শৈত্যেরও প্রভাব রয়েছে। দেখা গেছে অনেক উদ্ভিদের অঙ্কুরিত বীজকে শৈত্য প্রদান করা হলে তাদের ফুল ধারণের সময় এগিয়ে আসে। শৈত্য প্রদানের মাধ্যমে উদ্ভিদের ফুল ধারণ ত্বরান্বিত করার প্রক্রিয়াকে ভার্নালাইজেশন (Vernalization) বলে। বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন যে উদ্ভিদের পুষ্প সৃষ্টিতে উষ্ণতার প্রভাব পড়ে। শীতের গম গরমকালে লাগালে ফুল আসতে বহু দেরি হয়। কিন্তু বীজ রােপণের পূর্বে 2° সেলসিয়াস-5° সেলসিয়াস উষ্ণতা প্রয়ােগ করলে উদ্ভিদে স্বাভাবিক পুষ্প প্রস্ফুটন ঘটে। কাজেই তােমরা দেখতে পাচ্ছ, আলাে, অভিকর্ষ, তাপ এ ধরনের উদ্দীপক উদ্ভিদের বৃদ্ধিকে প্রভাবিত। করে। এভাবেই উদ্ভিদ তার শারীরবৃত্তীয় বিভিন্ন কাজের মধ্যে সমন্বয় ঘটায়।

চলন (Movement):

উদ্ভিদ অন্যান্য জীবের মতাে অনুভূতি ক্ষমতাসম্পন্ন। এজন্য অভ্যন্তরীণ বা বহি-উদ্দীপক উদ্ভিদদেহে যে উদ্দীপনা সৃষ্টি করে, তার ফলে উদ্ভিদে চলন ঘটে। কতগুলাে চলন উদ্ভিদদেহের বৃদ্ধিজনিত আবার কিছু চলন অভ্যন্তরীণ এবং পারিপার্শ্বিক উদ্দীপকের প্রভাবে হয়ে থাকে। চলন যেভাবেই হােক না কেন তা অবশ্যই কোনাে না কোনাে প্রভাবকের কারণে ঘটে থাকে। উদ্ভিদ চলনকে প্রধানত দুভাগে ভাগ করা যায়, সামগ্রিক চলন (Movement of locomotion) এবং বক্ৰচলন (Movement of curvature)। উদ্ভিদদেহের কোনাে অংশ যখন সামগ্রিকভাবে প্রয়োজনের তাগিদে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমন করে তাকে সামগ্রিক চলন বলে। যেমন, ছত্রাক এবং উন্নত শ্রেণির উদ্ভিদের যৌনজনন কোষে (Garmetes) কিংবা জুস্পােরে— এ ধরনের চলন দেখা যায়। তাছাড়া কিছু ব্যাকটেরিয়া এবং কিছু শৈবাল, যেমন: Volvox, Chlamydomonas ও ডায়াটম | শৈবালে এই ধরনের চলন দেখা যায়। অন্যদিকে মাটিতে আবদ্ধ উন্নতশ্রেণির উদ্ভিদ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলাচল করতে পারে না। এবং এদের অঙ্গগুলাে নানাভাবে বেঁকে যায়। এ ধরনের চলনকে বক্ৰচলন বলে। কাণ্ডের আলােকমুখী চলন, মূলের অন্ধকারমুখী চলন, আকর্ষী অবলম্বনকে পেঁচিয়ে ধরা ইত্যাদি ক্ৰচলনের উদাহরণ। সামগ্রিক চলন এবং ক্ৰচলন আবার নানা ধরনের হয়। তার মধ্যে ফটোট্রপিক চলন উল্লেখযােগ্য।
what image shows
ফটোট্রপিক চলন বা ফটোট্রপিজম (Phototropic movement or phototropism): ফটোট্রপিক চলন এক ধরনের বক্ৰচলন। উদ্ভিদের কাণ্ড এবং শাখা-প্রশাখার সবসময় আলাের দিকে। চলন ঘটে এবং মূলের চলন সবসময় আলাের বিপরীত দিকে হয়। কাণ্ডের আলাের দিকে চলনকে পজিটিভ ফটোট্রপিজম এবং মূলের আলাের বিপরীত দিকে চলনকে নেগেটিভ ফটোট্রপিজম বলে। একক কাজ কাজ : শ্রেণিকক্ষের জানালায় টবসহ একটি উদ্ভিদ রেখে এক সপ্তাহ পর্যবেক্ষণ কর এবং প্রাপ্ত ফলাফল যুক্তিসহ উপস্থাপন কর। একক কাজ কাজ : কয়েকটি অঙ্কুরিত ছােলা বীজের সাহায্যে মূলের ভূ-অভিমুখী চলন পরীক্ষা কর ও প্রান্ত ফলাফল যুক্তিসহ উপস্থাপন কর। 10.2 প্রাণীর সমন্বয় প্রক্রিয়া হরমােনাল প্রভাব। প্রাণীর প্রয়ােজনীয় সমন্বয় কাজ স্নায়ু ছাড়াও হরমােন দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। হরমােনের কারণে। প্রাণী তার কার্যকলাপ অথাৎ নড়াচড়া বা আচরণের পরিবর্তন করে থাকে। এই বিষয়টি নিয়ে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় প্রচুর গবেষণা হয়েছে। নানা ধরনের নালিহীন গ্রন্থি থেকে হরমােন নিঃসৃত হয়। নালিহীন গ্রন্থিগুলাে একে অপরকে নিয়ন্ত্রণ করে। আবার স্নায়ুতন্ত্র নালিহীন গ্রন্থির কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে। কোনাে কার্যক্রমে হরমােনকে যদি কারখানার শ্রমিক ধরা হয়, তাহলে সার্বিকভাবে কোন শ্রমিক কোথায়, কতক্ষণ কাজ করবে, সেটি যেরকম ব্যবস্থাপক নিয়ন্ত্রণ করেন, স্নায়ুতন্ত্রও তেমনি ব্যবস্থাপকের মতাে হরমােনের কাজ নিয়ন্ত্রণ করে। উল্টো দিকে স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশ এবং কাজের উপর রয়েছে হরমােনের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব। প্রথমে ধারণা ছিল, সব হরমােনই বুঝি উত্তেজক পদার্থ। কিন্তু পরবর্তীকালে দেখা গেছে সব হরমােন উত্তেজক নয়, এদের মধ্যে কিছু কিছু নিস্তেজকও আছে। হরমােন অতি অল্প পরিমাণে বিশেষ বিশেষ শারীরবৃত্তীয় কাজ বা পদ্ধতি সূক্ষ্মভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। এরা উত্তেজক ৰা নিস্তেজক হিসেবে দেহের পরিচ্ছটন, বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন টিস্যর কার্য নিয়ন্ত্রণ করে। ব্যক্তির আচরণ, স্বভাব এবং আবেগপ্রবণতার উপরও হরমােনের প্রভাব অপরিসীম। এগুলাে রক্তের মাধ্যমে পরিবাহিত হয়ে উৎপত্তিস্থল থেকে দেহের দূরবর্তী কোনাে কোষ বা অঙ্গকে উদ্দীপিত করে। এজন্য এদেরকে কখনাে কখনাে রাসায়নিক দূত (Chemical messenger) হিসেবেও অভিহিত করা হয়। জীবনের কর্মকান্ডে সমন্বয় সাধনে নানা প্রাণী হরমােন ব্যবহার করে। পিপড়া খাদ্যের খোঁজ পেলে খাদ্যের উৎস থেকে বাসায় আসার পথে এক ধরনের হরমােন নিঃসৃত করে, যাকে ফেরােমন বলে। এর উপর নির্ভর করে অন্য পিপড়াগুলােও খাদ্য উৎসে যায় এবং খাদ্য সংগ্রহ করে বাসায় ফিরে আসে। এ কারণে পিপড়াদের এক সারিতে চলাচল করতে দেখা যায়। খাদ্য শেষ হলে পিপড়া ফেরােমন নিশ্বরণ বন্ধ করে দেয়, যা সহজেই বাতাসে উবে যায়, তখন অন্য পিপড়া আর খাদ্য সংগ্রহে যায় না। কোনাে কোনাে পতঙ্গ ফেরােমন দিয়ে তার প্রজাতির সঙ্গীকে খুঁজে পেতে পারে। দেখা গেছে কোনাে কোনো পতল বাতাসে ফেরােমন নিঃসৃত করলে 2-4 কিলােমিটার দূর থেকে তার সঙ্গীরা আকৃষ্ট হয়। তোমরা হয়তাে ফেরােমন ব্যবহার করে পােকা ধ্বংসের ফাঁদ তৈরি করার কথা শুনেছ। এ পদ্ধতিতে ফেরােমনের কারণে আকৃষ্ট হয়ে অনিষ্টকারী পােকা ফাঁদে এসে পানিতে ডুবে মারা যায়। অনিষ্টকারী পােকা দমনে এ পদ্ধতিটিই খুবই পরিবেশবান্ধব। স্নায়বিক প্রভাব হাঁটাচলা, উঠাবসা, কথা বলা, চিন্তা করা, লেখা-পড়া করা, হাসিকান্না ইত্যাদি কাজ করার জন্য দেহের বিভিন্ন অঙ্গ অংশ নেয়। এ অঙ্গগুলােকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে হলে একটি সময় ব্যবস্থার প্রয়ােজন হয়। স্নায়ুত এবং হরমােনত মিলে দেহের এই কাজ পরিচালনা, নিয়ন্ত্রণ এবং সমন্বয় করে। যে তন্ত্রের সাহায্যে প্রাণী উত্তেজনায় সাড়া দিয়ে প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে, দেহের বিভিন্ন অঙ্গের মধ্যে সংযোেগ রাখে, তাদের কাজে শৃঙ্খলা আনে এবং শারীরবৃত্তীয় কাজ নিয়ন্ত্রণ করে, তাকেই সায়ত বলে। আমাদের সারা শরীরের বিভিন্ন কাজের ভিতর সুসংবদ্ধতা আনার জন্য লক্ষ লক্ষ কোষের কাজের সমন্বয় সাধন (Co-ordination) করতে হয়। দেহের বিভিন্ন অঙ্গের কাজের সমন্বয় সাধনের জন্য স্নায়ুতন্ত্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমাদের দেহ চলে পরিবেশের উদ্দীপনায় সাড়া জাগানাের ফলে। দেহের বাইরের জগৎ হলাে বাহ্যিক পরিবেশ এবং দেহের ভিতর হলাে অভ্যন্তরীণ পরিবেশ। বাহ্যিক পরিবেশের উদ্দীপক হলাে আলাে, গন্ধ, স্বাদ এবং স্পর্শ- এগুলাে আমাদের চোখ, কান, নাক, জিহ্বা এবং ত্বকের অনুভূতিবাহী স্নায়ুপ্রান্তে উদ্দীপনা জাগায়। আবার অভ্যন্তরীণ পরিবেশের উদ্দীপক হলাে চাপ, তাপ এবং বিভিন্ন রাসায়নিক বস্তু। এরা অভ্যন্তরীণ অঙ্গের কেন্দ্রমুখী প্রান্তে উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। এই দুই ধরনের উদ্দীপকই অনুভূতি কিংবা কেন্দ্রমুখী স্নায়ুতে তাড়না সৃষ্টি করে। এই তাড়না মস্তিষ্কে পৌঁছে, মতি সিদ্ধান্ত নিয়ে আজ্ঞাবাহী (বা মােটরষায়) এর মাধ্যমে পেশি কিংবা গ্রন্থিতে সাড়া জাগায় এবং কোনাে কাজ করতে সাহায্য করে। 10.3 স্নায়ুতন্ত্র মায়ুত দেহের বিভিন্ন অঙ্গ এবং তন্মের মধ্যে সমন্বয় করে, দেহের বিভিন্ন অংশে উদ্দীপনা বহন করে এবং দেহের উদ্দীপনায় সাড়া দিয়ে পরিবেশের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে। নীচে স্নায়ুতন্ত্রের বিন্যাস ছকে দেওয়া হলাে:
what image shows
10.3.1 কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র (Central nervous system) মস্তিষ্ক এবং মেরুমজ্জা (বা সুষুম্নকাণ্ড) দিয়ে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র গঠিত। মস্তিষ্ক করােটিকার মধ্যে সুরক্ষিত থাকে। মস্তি (Brain) সুষুম্নাকাণ্ডের শীর্ষে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের যে ষ্টীত অংশ করােটিকার মধ্যে অবস্থান করে, তাকে মস্তিষ্ক বলে। মস্তিষ্ক স্নায়ুতন্ত্রের পরিচালক। মস্তিষ্ক তিনটি অংশে বিভক্ত— অগ্রমস্তিষ্ক, মধ্যমস্তিষ্ক এবং পশ্চাৎফি । (a) অমস্তিষ্ক (Forebrain বা Prosencephalon) মস্তিষ্কের মধ্যে অগ্রমস্তিষ্ক বা সেরিব্রাম সবচেয়ে বড় অংশ। সেরিব্রামকে গুরুমস্তিষ্কও বলা হয়ে থাকে। সেরিব্রামের ডান ও বাম অংশ দুটি সম্পূর্ণভাবে বিভক্ত। দুটি অংশের মাঝখানে বিভেদক খাজ থাকায় এ বিভক্তি ঘটে। এদের সেরিব্রাল হেমিস্ফিয়ার (cerbral hemisphere) বলা হয়। সেরিব্রামের ডান ও বাম হেমিস্ফিয়ারের মধ্যে খাঁজ থাকলেও এ দুটি অংশ একগুচ্ছ নিউরন দিয়ে সংযুক্ত থাকে, যার নাম কর্পাস ক্যালােসাম। বাম সেরিব্রাল হেমিস্ফিয়ার দেহের ডান অংশ এবং ডান সেরিব্রাল হেমিস্ফিয়ার দেহের বাম অংশকে নিয়ন্ত্রণ করে। মস্তিষ্কের এ অংশটির উপরিভাগ ঢেউ তােলা। এটি মেনেনজেস নামক পর্দা দিয়ে আবৃত থাকে। সেরিব্রামের বাইরের স্তরের নাম কর্টেক্স। কর্টেক্স অসংখ্য নিউরনের কোষদেহ দিয়ে গঠিত। এর রং ধূসর। তাই কর্টেক্সের অপর নাম গ্রে ম্যাটার (Gray matter) বা ধূসর পদার্থ। অপরদিকে, সেরিব্রামের গভীর স্তরটি গঠিত হয় ঐসব নিউরনের অ্যাক্সন দিয়ে, যা সাদা রঙের মায়েলিন | (mayalin) আবরণে আবৃত। তাই সেরিব্রাল কর্টেক্সের গভীরে থাকে সাদা রঙের স্তর বা হােয়াইট ম্যাটার (white matter)। সেরিব্রাম হলাে প্রত্যেক অঙ্গ থেকে স্নায়ুতাড়না গ্রহণের এবং প্রত্যেক অঙ্গে স্নায়ুতাড়না প্রেরণের উচ্চতর কেন্দ্র। দেহ সঞ্চালন তথা প্রত্যেক কাজ ও অনুভূতির কেন্দ্র হলাে সেরিব্রাম। এটি আমাদের চিন্তা, চেতনা, জ্ঞান, স্মৃতি, ইচ্ছা, বাকশক্তি ও ঐচ্ছিক পেশির কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে। কোন উদ্দীপকের প্রতি কী ধরনের সাড়া দিবে, সে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করে। সকল প্রাণীর মধ্যে মানুষের অগ্ৰমস্তিষ্কের। বিবর্তন সর্বাধিক অগ্রগামী এবং সবচেয়ে বিকশিত।
(b) মধ্যমস্তিষ্ক (Midbrain বা Mesencephalon) পশ্চাৎ মস্তিষ্কের উপরের অংশ হলাে মধ্যমস্তিষ্ক। এটি অগ্র ও পশ্চাৎ মস্তিষ্ককে সংযুক্ত করে। মধ্যমস্তিস্কের পিছনে অবস্থিত নলাকৃতি বৃহৎ অংশের নাম পনস (Pons)। এটি সেরিবেলাম ও মেডুলা অবলংগাটার মধ্যে সংযােগ স্থাপন করে। বিভিন্ন পেশির কাজের সমন্বয়সাধন ও ভারসাম্য রক্ষা করা। | মধ্যমস্তিষ্কের কাজ। দর্শন ও শ্রবণের ক্ষেত্রেও রয়েছে মধ্যমস্তিষ্কের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। (e) পশ্চাৎ মস্তিষ্ক (Hindbrain Rhombencephalon) | এটি সেরিবেলাম, পনস ও মেডুলা অবলংগাটা নিয়ে গঠিত। (i) সেরিবেলাম (cerebellum): পনসের পৃষ্ঠভাগে অবস্থিত খণ্ডাংশটি সেরিবেলাম। এটি ডান এবং বাম দুই অংশে বিভক্ত। এর বাইরের দিকে ধূসর পদার্থের অবরণ এবং ভিতরের দিকে শ্বেত পদার্থ থাকে। সেরিবেলাম দেহের পেশির টান নিয়ন্ত্রণ, চলনে সমন্বয় সাধন, দেহের ভারসাম্য রক্ষা, দৌড়ানাে এবং লাফানাের কাজে জড়িত পেশিগুলাের কার্যাবলি নিয়ন্ত্রণ করে। (i) পনস (Pons): মেডুলা অবলংগাটা এবং মধ্যমস্তিষ্কের মাঝখানে পনস অবস্থিত। এটি একগুচ্ছ স্নায়ুর সমন্বয়ে (ii) মেডুলী অবলংগটা (Medulla oblongata): এটি মস্তিষ্কের সবচেয়ে পিছনের অংশ। এর সামনের দিকে রয়েছে পনস, পিছনের দিক সুষুম্নাকাণ্ডের উপরিভাগের সথে মােট বারাে জোড়া করােটিক স্নায়ুর (Cranial nerves) | মধ্যে মেডুলা অবলংপাটা থেকে আট জোড়া করােটিক স্নায় উৎপন্ন হয়। এর স্নায়ু খাদ্য গলাধঃকরণ, হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, গলবিল ইত্যাদির কিছু কাজ নিয়ন্ত্রণ করে। তাছাড়া এই স্নায়ুগুলাে শ্রবণ এবং ভারসাম্যের মতাে গুরুত্বপূর্ণ কাজের সাথে জড়িত। মস্তিষ্ক থেকে বের হওয়া বারাে জোড়া করােটিক স্নায়ু মাথা, ঘাড়, মুখমণ্ডল, মুখগহ্বর, জিহবা, চোখ, নাক, কান ইত্যাদি অঞ্চলে বিস্তৃত। যায়গুলাে সংবেদী, মােটর অথবা মিশ্র প্রকৃতির।
মেরুরজ্জ্ব (spinal cord) মেরুরজ্জু করােটির পিছনে অবস্থিত ফোরামেন ম্যাগনাম (Foramen magrium) নামক ছিদ্র থেকে কটিদেশের কশেরুকা পর্যন্ত বিস্তৃত। মেরুরজ্জ্ব বা সুষুম্না কাণ্ড মেরুদণ্ডের কশেরুকার ভিতরের ছিদ্রপথে সুরক্ষিত থাকে। মেরুরজুতে শ্বেত পদার্থ এবং ধূসর পদার্থ থাকে। তবে এদের অবস্থান মতিফের ঠিক উল্টো। অর্থাৎ শ্বেত পদার্থ থাকে বাইরে আর ভিতরে থাকে ধূসর পদার্থ। দুই কশেরুকার মধ্যবর্তী ছিদ্র দিয়ে মেরুরজ্জ্ব থেকে 31 জোড়া মেরুরজ্জীয় স্নায়ু (Spinal nerves) বের হয়। এসব ঘাড়, গলা, বুক, পিঠ, হাত ও পায়ের স্নায়ু। এসব স্নায়ু মিশ্র প্রকৃতির। স্নায়ুকলা (Nervous tissue) যে কলা দেহের সব ধরনের সংবেদন এবং উদ্দীপনা গ্রহণ করে এবং তা পরিবহনের মাধ্যমে উদ্দীপনা অনুসারে উপযুক্ত প্রতিবেদন সৃষ্টি করে, সেটাই স্নায়ুটি বা স্নায়ুকলা। বহুসংখ্যক স্নায়ুকোষ বা নিউরনের। সমন্বয়ে স্নায়ুটিস্যু গঠিত। নিউরনই স্নায়ুতন্ত্রের গঠন এবং কার্যক্রমের একক। নিউরনের গঠন | প্রতিটি নিউরন দুটি অংশ নিয়ে পঠিত কোষদেহ এবং প্রলম্বিত অংশ। (a) কোষদেহ (cell body): প্লাজমামেমব্রেন, সাইটোপ্লাজম আর নিউক্লিয়াস নিয়ে গঠিত নিউরনের। গােলাকার, তারকাকার, অথবা ডিম্বাকার অংশ কোষদেহ নামে পরিচিত। এখানে সাইটোপ্লাজমে। মাইটোকন্ড্রিয়া, গলজিবস্তু, লাইসােজোম, চর্বি, গ্লাইকোজেন, রঞ্জক কণাসহ অসংখ্য নিসল দানা থাকে। | (b) প্রলম্বিত অংশ: কোষদেহ থেকে সৃষ্ট শাখা-প্রশাখাকেই প্রলম্বিত অংশ বলে। প্রলম্বিত অংশ দুই | ধরনের
(i) ডেনড্রন (Dendron): কোষদেহের চারদিকের শাখাযুক্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রলম্বিত অংশকে ডেনড্রন বলে। ডেনড্রন থেকে যে শাখা বের হয়। তাদের ডেনড্রাইট বলে। একটি নিউরনে ডেনড্রন সংখ্যা শূন্য থেকে শতাধিক পর্যন্ত হতে পারে। ডেনড্রাইট অন্য নিউরন থেকে স্নায়ু তাড়না গ্রহণ করে। | (ii) অ্যাক্সন (Axon): কোষদেহ থেকে উৎপন্ন বেশ লম্বা তন্দুটির নাম অ্যাক্সন। এর চারদিকে পাতলা আবরণটিকে নিউরিলেমা বলে। নিউরিলেমা এবং অ্যাক্সনের মধ্যবর্তী অঞ্চলে স্নেহ পদার্থের একটি স্তর থাকে। একে মায়েলিন (Myelin) বলে। অ্যাক্সিনের শেষ মাথা অ্যাক্সন টারমিনালে বিভক্ত হয়ে যায়, এবং এই টারমিনালগুলো দিয়ে সিন্যাপস মারফত অন্য নিউরনের ডেনড্রাইটে স্নায়ু তাড়না প্রেরণ করা হয়।
বহুসংখ্যক অ্যাক্সন ও ডেনড্রাইট মিলিত হয়ে স্নায়ু গঠন করে। নিউরিলেমা আবরণটি অবিচ্ছিন্ন নয়। নির্দিষ্ট দূরত্ব পর পর এটি সাধারণত বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকে। শুধু এই বিচ্ছিন্ন অংশে নিউরিলেমার সাথে অ্যাক্সনের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শ ঘটে। এই আবরণীবিহীন অংশগুলাে র্যানভিয়ারের পর্ব (Node of Ranvier) নামে পরিচিত। অ্যাক্সনের মূল অক্ষের আবরণীকে অ্যাক্সলেমা (Axolema) বলে। একটি নিউরনের অ্যাক্সনের টারমিনালের সাথে দ্বিতীয় একটি নিউরনের ডেনড্রাইট সরাসরি যুক্ত থাকে না। এই সূক্ষ্ম ফাঁকা সংযােগস্থলকে সিন্যাপস (synapse) বলে। প্রকৃতপক্ষে পর পর অবস্থিত দুটি নিউরনের সন্ধিস্থল হলাে সিন্যাপস। অ্যাক্সন টারমিনাল সিন্যাপসের মধ্য দিয়ে তড়িৎ রাসায়নিক (Electro chemical) পদ্ধতিতে | আয় তাড়না প্রবাহিত হয়। সিন্যাপসে নিউরােহিউমার নামক তরল পদার্থ থাকে। কোনাে একটি নিউরনের মধ্য দিয়ে স্নায়ু তাড়না প্রবাহিত হয়ে সিন্যাপস অতিক্রম করে পরবর্তী নিউরনে যায়। অর্থাৎ এর ভিতর | দিয়ে যায় উদ্দীপনা বা স্নায়ু তাড়না একদিকে পরিবাহিত হয়। মানুষের মস্তিষ্কে প্রায় একশত বিলিয়ন নিউরন রয়ছে এবং প্রতিটি নিউরন অন্য সাত থেকে দশ হাজার নিউরনের সাথে সিন্যাপস সংযােগ করে থাকে।
নিউরনের প্রধান কাজ উদ্দীপনা বহন করা। অনুভূতিবাহী বা সংবেদী নিউরন গ্রাহক অঙ্গ থেকে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে এবং মােটর বা অজ্ঞবাহী নিউরন কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র থেকে কার্যকরী অঙ্গে উদ্দীপনা প্রেরণ। একক কাজ কাজ ; একটি নিউরনের চিত্র এঁকে এর বিভিন্ন অংশ চিহ্নিত কর। একটি টর্চ লাইট দিয়ে তােমার বন্ধুর চোখে আলাে ফেল। লক্ষ করে দেখ, আলাে ফেলার সঙ্গে সঙ্গে। চোখের তারা ছােট হয়ে গেল। কেন এমন হলাে? আলাের উদ্দীপনাজনিত তাড়না রেটিনা থেকে মস্তিষে পৌঁছালে এর নির্দেশে আইরিশের বৃত্তাকার বা গােলাকার পেশি সংকুচিত হয়। ফলে চোখের তারা ছােট হয়ে যায়। উদ্দীপনার আকস্মিকতায় স্বয়ংক্রিয় প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হওয়ার ফলে তৎক্ষণাৎ চোখ বন্ধ হয়ে যায়। প্রতিবর্তী ক্রিয়া (Reflex action) প্রতিবর্ত ক্রিয়া বলতে উদ্দীপনার আকস্মিকতা এবং তার কারণে স্বয়ংক্রিয় প্রতিক্রিয়াকে বােঝায়। হঠাৎ করে আঙ্গুলে সুচ ফুটলে অথবা হাতে গরম কিছু পড়লে আমরা দ্রুত হাতটি উদ্দীপনার স্থান থেকে সরিয়ে নিই, এটি প্রতিবর্তী ক্রিয়ার ফল। আমরা চাইলেও প্রতিবর্তী ক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি । প্রতিবর্তী ক্রিয়া মুলত সুষুমাকাণ্ড দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়, মস্তিষ্ক দিয়ে নয়। অর্থাৎ যেসব উদ্দীপনার। প্রতিক্রিয়া মস্তিষ্ক দিয়ে না হয়ে সুষুম্নাকাণ্ড দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়, তাকে প্রতিবর্তী ক্রিয়া বলে। অসতর্কভাবে সেলাই করার সময় আঙ্গুলে সুঁচ ফুটলে তাৎক্ষণিকভাবে হাত অন্যত্র সরে যাওয়ার প্রতিবর্তী ক্রিয়াটি এভাবে ব্যাখ্যা করা যায়: আঙ্গুলে সুচ ফুটার সময় আঙ্গুলের ত্বকে অবস্থিত সংবেদী নিউরন ব্যথার উদ্দীপনা গ্রহণ করে। এখানে ত্বক গ্রাহক অঙ্গ হিসেবে কাজ করে। আঙ্গুলের ত্বক থেকে এ উদ্দীপনা সংবেদী নিউরনের অ্যাক্সনের মাধ্যমে স্নায়ুকাণ্ডের ধূসর অংশে পৌঁছায়। স্নায়ুকান্ডের ধুসর অংশে অবস্থিত সংবেদী নিউরনের অ্যাক্সন থেকে তড়িৎ রাসায়নিক পদ্ধতিতে উদ্দীপনা। মধ্যবর্তী বা রিলে নিউরনের মাধ্যমে মােটর বা আজ্ঞাবাহী স্নায়ু কোষের ডেনড্রাইটে প্রবেশ করে। আজ্ঞাবাহী স্নায়ুর অ্যাক্সনের মাধ্যমে এ উদ্দীপনা পেশিতে প্রবেশ করে।
উদ্দীপনা পেশিতে পৌঁছালে পেশির সংকোচন ঘটে। ফলে উদ্দীপনাস্থল থেকে হাত দ্রুত আপনা-আপনি সরে যায়। 10.3.2 প্ৰান্তীয় স্নায়ুতন্ত্র (Peripheral nervous system) মস্তিস্ক থেকে 12 জোড়া এবং মেরুমজ্জা বা সুষুম্নাকাণ্ড থেকে 31 জোড়া স্নায়ু বের হয়ে আসে এবং সূক্ষ থেকে সূক্ষ্মতর শাখায় বিভক্ত হয়ে সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। এগুলােকে একত্রে প্রান্তীয় স্নায়ুতনা বলে। | মক্ষি থেকে উৎপন্ন করােটিক স্নায়ু চোখ, নাক, কান, জিহ্বা, দাঁত, মুখমণ্ডল, হৃৎপিণ্ড, পাকস্থলী। প্রভৃতি অঙ্গের কাজ নিয়ন্ত্ৰণ করে। মেরুরজ্ঞ থেকে উদ্ভূত স্নায়ুগুলাে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ চালনা করে এবং দেহের বাকি অংশ থেকে যাবতীয় অনুভূতি মস্তিষ্কে বয়ে নিয়ে যায়। স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্র (Autonomic nervous system) যেসব অঙ্গের উপর আমাদের কোনাে নিয়ন্ত্রণ নেই, সেগুলাে স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্র দিয়ে পরিচালিত ও নিয়তি হয়। দেহের ভিতরের অঙ্গগুলাে, যেমন: হৃৎপিণ্ড, অল্ম, পাকস্থলী, অগ্ন্যাশয় ইত্যাদির কাজ। স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্র দিয়ে পরিচালিত হয়। এসব তন্ত্রের কার্যকারিতার উপর মস্তিষ্ক ও মেরুরজ্জুর প্রত্যক্ষ। প্রভাব না থাকায় এরা অনেকটা স্বাধীন এবং স্বতন্ত্রভাবে আপন কর্তব্য সম্পাদন করে। উদ্দীপনা সঞ্চালন (Transmission of Impulse)। পরস্পর সংযুক্ত অসংখ্য নিউরন তন্তুর ভিতর দিয়ে উদ্দীপনা বা তাড়না শেষ পর্যন্ত মস্তিষ্কে পেঁছিয়। প্রতি সেকেন্ডে এর বেগ প্রায় 100 মিটার তবে স্নায়ুর ধরনভেদে এর তারতম্য হতে পারে। পরিবেশ থেকে যে সংকেত স্নায়ুর ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মস্তিষ্কে পৌঁছে তাকে স্নায়ু তাড়না বা উদ্দীপনা বলে। নিউরনের কার্যকারিতার ফলে উদ্দীপনা প্রয়ােজনীয় অঙ্গগুলােতে সঞ্চালিত হয়। এটি মাংসপেশিতে সঞ্চালিত হলে পেশি সংকুচিত হয়ে সাড়া দেয়। ফলে প্রয়ােজনমতাে দেহের বিভিন্ন অঙ্গ সঞ্চালিত হয়। এই তাড়না গ্রন্থিতে পৌঁছালে সেখানে রস ক্ষরিত হয়। অনুভূতিবাহী স্নায়ু উত্তেজিত হলে সেই উত্তেজনা মস্তিষ্কের দিকে অগ্রসর হয়ে যন্ত্রণাৰােধ, স্পর্শক্তজ্ঞান, দর্শন এ ধরনের অনুভূতি উপলব্ধি করায়।
স্নায়ু তাড়না কীভাবে কাজ করে তা একটি উদাহরণ দিয়ে বুঝানাে যায়। মনে কর, শিক্ষক সুতলিপি দিচ্ছেন এবং তুমি লিখছ। এক্ষেত্রে পুস্তক থেকে প্রতিফলিত আলাে শিক্ষকের চোখের রেটিনায় উদ্দীপনা। | জাগালে স্নায়ু তাড়নার সৃষ্টি হয়। এটা চোখের স্নায়ু দিয়ে মস্তিষ্কের দৃষ্টিকেন্দ্রে পৌঁছে। সেখান থেকে | এ তাড়না পর পর চিকেন্দ্র, স্মৃতিকেন্দ্র প্রভৃতি হয়ে মুখমণ্ডলের ঐচ্ছিক পেশিকে নির্দেশ দেয়। মুখের পেশি সংকুচিত প্রসারিত হয়ে হয়ে সাড়া দেয়। এখানে শিক্ষকের কথা বলার পেশিগুলাে হলো প্রধান। সড়িী অশ। শিক্ষকের কথা বাতাসে শব্দ তরঙ্গ সৃষ্টি করে। এই শব্দ তরঙ্গ ছাত্রের কানের পর্দায় উদ্দীপনা জাগায়, যা শ্রবণমায়ুর মাধ্যমে মস্তিষ্কের শ্রবণকেন্দ্রে পৌঁছে। সেখান থেকে তাড়না ছাত্রের স্মৃতিকেন্দ্র, চিন্তাকেন্দ্র | প্রভৃতি হয়ে মােটরয়ামুযােগে ছাত্রের হাতের ঐচ্ছিক পেশিতে পোঁছে। নির্দেশে সাড়া দিয়ে হাতের পেশি লিখতে থাকে। এখানে ছাত্রের পেশি হলাে প্রধান সাড়া অঙ্গ। 10.4 হরমােন মানুষ এবং বিভিন্ন প্রাণীর দেহে একধরনের বিশেষ নালিবিহীন গ্রন্থি থাকে। এসব গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত রস রক্তের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়ে দেহের বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় কাজ নিয়ন্ত্রণ করে। নালিবিহীন গ্রন্থি নিঃসৃত এ ধরনের রসকে হরমোন বলে। হরমোন পরিবহনের জন্য পৃথক কোনাে নালি নেই। হরমােন | রক্তস্রোতের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়ে নির্দিষ্ট লক্ষ্যকোষে পৌছে কোষের প্রাণরাসায়নিক কার্যকলাপকে | প্রভাবিত করে, জৈবিক কার্যাবলি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করে। সুস্থ দেহের চাহিদা অনুসারে গ্রশ্মি থেকে অবিরত ধারায় হরমােন নিঃসৃত হয়। তবে প্রয়ােজন অপেক্ষা কম অথবা বেশি পরিমাণ হরমােন নিঃসৃত হলে শরীরে নানারকম অবাঞ্ছিত প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।
10.4.1 মানবদেহের কয়েকটি মুখ্য নালিবিহীন গ্রন্থির পরিচিতি, কাজ ও নিঃসৃত হরমােন (a) পিটুইটারি গ্রন্থি (Pituitary gland); পিটুইটারি গ্রন্থি বা হাইপােফাইসিস মস্তিষ্কের নিচের অংশে অবস্থিত। এটি মানবদেহের প্রধান হরমােন উৎপাদনকারী গ্রন্থি। কারণ একদিকে পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হরমােন সংখ্যায় যেমন বেশি, অপরদিকে অন্যান্য গ্রন্থির উপর এসব হরমােনের প্রভাবও বেশি। দেহের সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ নালিবিহীন গ্রন্থি হলেও এটি আকারে সবচেয়ে ছােট। এই গ্রন্থি থেকে গোনাডােট্রপিক, সোমাটোট্রপিক, থাইরয়েড উদ্দীপক হরমােন (TSH), এডরেনােকর্টিকোট্রপিন ইত্যাদি হরমোন নিঃসৃত হয়। এটি অন্যান্য | গ্রন্থিকে প্রভাবিত করা ছাড়াও মানবদেহের বৃদ্ধির হরমােন নির্গত করে। (b) থাইরয়েড গ্রন্থি (Thyroid gland): | থাইরয়েড গ্রন্থি গলায় ট্রাকিয়ার উপরের অংশে অবস্থিত। এই গ্রন্থি থেকে প্রধানত থাইরক্সিন হরমােন নিঃসরণ হয়। থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হরমােন থাইরক্সিন (Thyroxine) সাধারণত মানবদেহে স্বাভাবিক বৃদ্ধি, বিপাকীয় কাজ নিয়ন্ত্রণ করে। থাইরয়েডের আরেকটি হরমােন ক্যালসিটোনিন (calcitonin) ক্যালসিয়াম বিপাকের সাথে জড়িত। (c) প্যারাথাইরয়েড গ্রন্থি (Parathyroid gland): একজন মানুষের সাধারণত চারটি প্যারাথাইরয়েড গ্রন্থি থাকে, যার সবগুলােই থাইরয়েড গ্রন্থির। পিছনে অবস্থিত। এই গ্রন্থি হতে নিঃসৃত প্যারাথরমােন (Parathormone) মূলত ক্যালসিয়াম এবং ফসফরাসের বিপাক নিয়ন্ত্ৰণ করে। (d) থাইমাস গ্রন্থি (rhymus gland): থাইমাস গ্রন্থি গ্রীবা অঞ্চলে অবস্থিত। থাইমাস গ্রন্থি দেহের রােগ প্রতিরােধ ক্ষমতা বিকাশে সাহায্য। করে। শিশুকালে এই গ্রন্থি বিকশিত থাকে পরে বয়ােবৃদ্ধির সাথে সাথে ছােট হয়ে যায়। এই গ্রন্থি থেকে থাইমােসিন (thymosin) হরমােন নিঃসরণ হয়। পূর্ণবয়স্ক মানুষে সাধারণত এই হরমােন থাকে। , থাকলেও খুবই নিম্ন মাত্রায়। (e) অ্যাডরেনাল বা সুগারেনাল গ্রন্থি (Adrenal gland): অ্যাডরেনাল গ্রন্থি কিডনির উপরে অবস্থিত। অ্যাডরেনাল গ্রন্থি দেহের অত্যাবশ্যকীয় বিপাকীয় কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে। এই গ্রন্থি মূলত কঠিন মানসিক ও শারীরিক চাপ থেকে পরিত্রাণে সাহায্য করে। অ্যাডরেনালিন (adrenalin) এই গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হরমােনগুলাের একটি। (0) আইলেটস অফ ল্যাংগারহ্যানস (Islets of langerhans): আইলেটস অফ ল্যাংগারহ্যানস অগ্ন্যাশয়ের মাঝে অবস্থিত, এই কোষগুচ্ছ শরীরের শর্করা বিপাক নিয়ন্ত্রণ করে। এর নালিহীন কোষগুলাে ইনসুলিন (insulin)ও গ্লুকাগন (glucagon) নিঃসরণ করে যা রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। (g) গােনাড বা জনন অল গ্রন্থি এটি মেয়েদের ডিম্বাশয় এবং ছেলেদের শুক্লাশয়ে অবস্থিত। জনন অঙ্গ থেকে নিঃসৃত হরমােন দেহের পরিণত বয়সের লক্ষণগুলাে বিকশিত করতে ভূমিকা রাখে। এছাড়াও প্রাণীর জনন অঙ্গের বৃদ্ধির পাশাপাশি জননচক্র এবং যৌন আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। জনন অঙ্গ থেকে পরিণত বয়সের পুরুষ দেহে টেস্টোস্টেরন (testosterone) এবং স্ত্রী-দেহে ইস্ট্রোজেন (estrogens) হরমােন উৎপন্ন হয়। 10.5 প্রাণরস বা হরমােনজনিত অস্বাভাবিকতা (a) থাইরয়েড সমস্যা সমুদ্রের পানিতে আয়ােডিন থাকায় সামুদ্রিক মাছ মানুষের খাদ্যে আয়ােডিনের অন্যতম মূল উৎস। আয়ােডিনযুক্ত খাবার খেলে থাইরয়েড হরমােন তৈরি হয়। দেখা গেছে, সমুদ্র থেকে দূরে অবস্থিত এলাকা যেমন হিমালয়ের পাদদেশে নেপাল কিংবা বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গে গলগণ্ড বা গয়টার বােগীর সংখ্যা অনেক বেশি। থাইরয়েড হরমােনের ঘাটতি হলে শিশুদের মানসিক বিকাশ বাধা পায়। গায়ের চামড়া খসখসে হয়, মুখমণ্ডল গােলাকার এবং চেহারায় স্বাভাবিক শিশুদের থেকে বৈসাদৃশ্য থাকে। আয়ােডিনের অভাবে হরমােন এর উৎপাদান ব্যাহত হলে শিশুদের বৃদ্ধির বিকাশ কমে যায়। এই জন্য খাদ্যে আয়ােডিনযুক্ত লবণ ব্যবহারে সুফল পাওয়া যায়। এছাড়া কলা, ফলমূল, কচু, সামুদ্রিক মাছ ইত্যাদি খেলে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। এ ব্যাপারে পঞ্চম অধ্যায়ে আরও আলােচনা করা হয়েছে। (b) বহুমূত্র বা ডায়াবেটিস (Diabetes)। অগ্ন্যাশয়ের ভিতর আইলেটস অব ল্যাঙ্গারহ্যানস নামক এক ধরনের গ্রন্থি আছে, এই গ্রন্থি থেকে ইনসুলিন (Insulin) নিঃসৃত হয়। ইনসুলিন হলাে এক ধরনের হরমােন, যা দেহের শর্করা পরিপাক নিয়ন্ত্রণ করে। অগ্ন্যাশয়ে যদি প্রয়ােজনমতাে ইনসুলিন তৈরি না হয় তবে রক্তে শর্করার পরিমাণ স্থায়ীভাবে বেড়ে যায়, প্রস্রাবের সাথে গ্লুকোজ নির্গত হয়। এ অবস্থাকে বহুমূত্র বা ডায়াবেটিস মেলিটাস (সংক্ষেপে: ডায়াবেটিস) বলে। ডায়াবেটিস প্রধানত দুই ধরনের, টাইপ-1 এবং টাইপ-2। টাইপ-1 এ আক্রান্ত রােগীর দেহে একেবাৱেই ইনসুলিন তৈরি হয় না। তাই নিয়মিতভাবে ইনজেকশনের মাধ্যমে ইনসুলিন নিতে হয়। অন্যদিকে টাইপ-2 রােগীর দেহে আংশিকভাবে ইনসুলিন তৈরি হয়। এক্ষেত্রে ঔষধ, অগ্ন্যাশয় কোষকে শরীরের জন্য পরিমিত ইনসুলিন তৈরিতে সাহায্য করে। তবে টাইপ-2 ডায়াবেটিসেও কোনাে না কোনাে পর্যায়ে ইনসুলিনের স্থায়ী ঘাটতি হয়ে যেতে পারে কিংবা বিভিন্ন অসুখ বা চিকিৎসাপদ্ধতির অংশ হিসেবে সেই সব ঔষধ বন্ধ রাখতে হতে পারে, তখন ইনসুলিন ছাড়া উপায় থাকে না। এ রােগটি সাধারণত বংশগতি এবং পরিবেশের প্রভাবে হয়ে থাকে। এটি সংক্রামক বা ছোঁয়াচে রােগ নয়। ৰ ও প্রস্রাবে গুকোজের মাত্রা পরিমাণের চেয়ে বেড়ে গেলে এই রােগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। লক্ষণগুলাে হলাে ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া, অধিক পিপাসা লাগা, ক্ষুধা বেড়ে যাওয়া, পর্যাপ্ত খাবার খাওয়া সত্বেও ন কমতে থাকা, দুর্বল বােধ করা, চোখে কম দেখা, চামড়া খসখসে ও রুক্ষ হয়ে যাওয়া, ক্ষতস্থান সহজে না শুকানাে ইত্যাদি। পুর্বে ধারণা করা হতাে কেবল বয়স্কদের এ রােগটি হয়। এ ধারণাটি সঠিক নয়। ছােট-বড় সব বয়সে এ রােগ হতে পারে। তবে যারা কায়িক পরিশ্রম করেন না, দিনের বেশির ভাগ সময় বসে কাজ করেন অথবা অলস জীবন যাপন করেন, তাদের ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। তাছাড়া স্থূলকায় | ববিদের এ রােগ হওয়ার আশঙ্কা বেশি। যেহেতু এ রোগ বংশগত, তাই কোনাে ব্যক্তির বাবা, মা, দাদা, দাদির এ রােগ থাকলে তার এ রােগ হওয়ার আশঙ্কা খুবই বেশি। বংশগতভাবে অনেক শিশুর দেহে ইনসুলিন উৎপাদন কম হয়, ফলে শিশুটি ইনসুলিন ঘাটতিজনিত অসুস্থতায় ভুগতে থাকে। ডায়াবেটিস রােগ নির্ণয় ও চিকিৎসা: রক্ত ও প্রস্রাব পরীক্ষা করে গ্লুকোজের মাত্রা নির্ণয়ের মাধ্যমে এ রােগ নির্ণয় করা যায়। চিকিৎসা করে ডায়াবেটিস রােগ একেবারে নিরাময় করা যায় না, কিন্তু এই লােগ। নিয়ণে রাখা যায়। ডাক্তারদের মতে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য তিনটি 'D' মেনে চলা অত্যাবশ্যক। এগুলাে হলাে: Discipline, Diet ও Dose। | (0) শুধলা (Discipline): একজন ডায়াবেটিস আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য তার সুশৃঙ্খল জীবনব্যবস্থা মহৌষধস্বরূপ। এছাড়া নিয়মিত এবং ডাক্তারের পরামর্শমতাে পরিমিত খাদ্য গ্রহণ করা, নিয়মিত ব্যায়াম করা, রােগীর দেহের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং বিশেষভাবে পায়ের যত্ন নেওয়া, নিয়মিত প্রস্রাব পরীক্ষা করা এবং দৈহিক কোনাে জটিলতা দেখা দিলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া। (ii) খাদ্য নিয়ন্ত্ৰণ (plet); ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের প্রধান উপায় হলাে খাদ্য নিয়ন্ত্রণ করা, মিষ্টিজাতীয় খাবার পরিহার করা ও ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত এবং সময়মতাে খাদ্য গ্রহণ করা। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী খাবারের মেনু অনুসরণ করলে সুফল পাওয়া যায়। তবে যার ডায়াবেটিস নেই, তার | মিষ্টি খাওয়া বা না খাওয়ার সাথে ডায়াবেটিসের সম্পর্ক নেই। (iii) ঔষধ সেবন (pose): ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোনাে ঔষধ সেবন করা উচিত নয়। ডাক্তার রােগীর শারীরিক অবস্থা বুঝে ঔষধ খাওয়া বা ইনসুলিন নেওয়ার পরামর্শ দেন। সেই পরামর্শ অনুযায়ী রােগীকে নিয়মিত ঔষধ সেবন করতে হবে। ঠিকমতাে চিকিৎসা না করা হলে রােগীর রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে কমে বা বেড়ে যায়। উভয় ক্ষেত্রেই রােগী বেহুঁশ হয়ে পড়তে পারে। এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। যদি ডায়াবেটিস রােগী হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যান, তখন তাকে বসিয়ে গ্লুকোজ বা চিনির পানি খাইয়ে দিলে অনেক সময় খারাপ পরিণতি এড়ানাে যেতে পারে। | (c) স্ট্রোক (stroke) মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটার কারণে স্নায়ুতন্ত্রের কাজে ব্যাঘাত ঘটলে তাকে স্ট্রোক বলে। স্ট্রোক হয় মস্তিষ্কে, হৃৎপিণ্ডে নয়; যদিও এ ব্যাপারে অনেকের ভুল ধারণা রয়েছে। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ বা রক্তনালির ভিতরে রক্ত জমাট বেঁধে রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্ত হওয়া— এই দুইভাবে স্ট্রোক হতে পারে। এর মধ্যে রক্তক্ষরণজনিত স্ট্রোক বেশি মারাত্মক। সাধারণত উচ্চ রক্তচাপের কারণে মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ হতে পারে। রােগের লক্ষণ: এই রােগের লক্ষণ হঠাৎ করেই প্রকাশ পায়। লক্ষণগুলাে হলাে: বমি হয়, প্রচণ্ড মাথাব্যথা। হয়, কয়েক মিনিটের মধ্যে রােগী সংজ্ঞা হারায়, ঘাড় শক্ত হয়ে যেতে পারে, মাংসপেশি শিথিল হয়ে যায়, শ্বসন এবং নাড়ির স্পন্দন কমে যায়, মুখমণ্ডল লাল বর্ণ ধারণ করে। অনেক সময় অবশ্য খুব। মারাত্মক উপসর্গ ছাড়াই শুধু মুখ বেঁকে যাওয়া বা অল্প সময়ের জন্য অজ্ঞান হয়ে গিয়ে আবার জ্ঞান। ফিরে আসা স্ট্রোকের এ জাতীয় লক্ষণ দেখা যায়। স্ট্রোক কতটা মারাত্মক তা বলতে হলে অন্তত কয়েক দিন রােগীকে পর্যবেক্ষণ করা প্রয়ােজন, সে সময়ে তাঁকে হাসপাতালে চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে। রাখতে হয়। তাই, স্ট্রোক হলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রােগীকে হাসপাতালে স্থানান্তরিত করতে হবে। এবং যথাযথ চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। উপযুক্ত চিকিৎসা করা হলে রােগী অনেক সময় বেঁচে যায়, তবে যদি রক্তক্ষরণজনিত স্ট্রোক হয়, তাহলে বাঁচার নিশ্চয়তা দেওয়া সম্ভব নয়। রােগী যদি বেঁচে যায়, তাহলে কয়েক ঘণ্টা থেকে কয়েক দিন পর সে তার সংজ্ঞা ফিরে পায়। তবে রােগী কিছুটা ছটফট করে। এবং আস্তে আস্তে অসাড় হয়ে যাওয়া অন্সে দৃঢ়তা ফিরে আসে। জ্ঞান ফিরে এলেও বাক নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র। যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে রােগীর কথা জড়িয়ে যায়। পক্ষাঘাত বা অবশ হয়ে যাওয়া অঙ্গ (যেমন: হাত) সংলগ্ন পেশি নড়াচড়ায় শক্তি ক্রমশ ফিরে আসে কিন্তু হাত দিয়ে সূক্ষ্ম কাজ করার ক্ষমতা সাধারণত পুরােপুরিভাবে ফিরে আসে না। চিকিৎসার প্রাথমিক পর্যায়ে আরােগ্য লাভ দ্রুত হতে থাকে কিন্তু দুমাস পরে উন্নতি ক্রমশ কমে আসে। হঠাৎ আক্রমণে যে স্নায়ু সাময়িকভাবে কার্যক্ষমতা হারায়, সেগুলাে দ্রুত আরােগ্য লাভ করে এবং কার্যক্ষমতা ফিরে পায়। আর যেসব স্নায়ু সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সেগুলাের কর্মক্ষমতা চিরতরে বিনষ্ট হয়ে যায়। রােগ নির্ণয় ও চিকিৎসা: মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ বা রক্ত জমাট বেঁধেছে কি না তা নির্ণয় করে এই রােগ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। এই রােগটির সঠিক কারণ অনেক সময় নির্ণয় করা সম্ভব হয় না। মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ বন্ধ করা সম্ভব নয়, তবে মস্তিষ্কে জমে থাকা কন্তু অনেক সময় অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে বের করার প্রয়ােজন হতে পারে। রােগীর উচ্চ রক্তচাপ থাকলে তা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা, রােগীর প্রয়ােজন অনুযায়ী সম্ভব হলে অস্ত্রোপচার করা যেতে পারে। রােগীকে উপযুক্ত শুশ্রষা, মলমূত্র ত্যাগের সুব্যবস্থা করা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, পথ্যের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা দরকার। প্রয়ােজনবােধে রােগীকে নলের সাহায্যে খাবার খাওয়ানাের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ফিজিক্যাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞ | এবং ফিজিওথেরাপিস্টের পরামর্শ মােতাবেক অবশ বা পক্ষাঘাতগ্রস্ত অঙ্গ নির্দিষ্ট নিয়মে নড়াচড়া করানাে দরকার, এতে ক্ষতিগ্রস্ত অঙ্গের অস্থিসন্ধি শ হয়ে যাওয়া রােধ করা সম্ভব হয়। রােগীর জ্ঞান | ফিরে এলে নিজ প্রচেষ্টায় নড়াচড়া করতে উৎসাহিত করা উচিত। প্রতিরােধের উপায়: ধূমপান পরিহার করা, যারা উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন, তাদের উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা, যারা ডায়াবেটিসে ভুগছেন তাদের নিয়মিত ঔষধ সেবন করা, দুশ্চিন্তামুক্ত, সুন্দর এবং স্বাভাবিক জীবন যাপন করা। 10.6 স্নায়বিক বৈকল্যজনিত শারীরিক সমস্যা (a) প্যারালাইসিস (Paralysis) শরীরের কোনাে অংশের ঐচ্ছিক মাংসপেশি ইচ্ছামতাে নাড়াতে পারার ক্ষমতা নষ্ট হওয়াকে প্যারালাইসিস বলে। সাধারণত মস্তিষ্কের কোনাে অংশের ক্ষতির কারণে ঐ অংশের সংবেদন গ্রহণকারী পেশিগুলাে কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে। একজনের আংশিক কিংবা সম্পূর্ণ প্যারালাইসিস হতে পারে, ফলে শরীরের একপাশে কোনাে অঙ্গ অথবা উভয় পাশের অঙ্গের কার্যকারিতা নষ্ট হয়, যেমন, দুই হাত ও পায়ের প্যারালাইসিস। কারণপ্যারালাইসিস সাধারণত স্ট্রোকের কারণে হয়। এছাড়া মেরুদণ্ডের বা ঘাড়ের সুষুদাকাণ্ড আঘাত বা দুর্ঘটনাজনিত কারণে প্যারালাইসিস হতে পারে। স্নায়ু রােগ, সুষুম্নাকাণ্ডের কিংবা কশেরুকার ক্ষয় রােগও প্যারালাইসিসের কারণ হতে পারে। (b) এপিলেপসি (Epilepsy) এপিলেপসি মস্তিষ্কের একটি রােগ, যাতে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে খিচুনি বা কাঁপুনি দিতে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে রােগী অজ্ঞান হয়ে পড়ে। এই রােগকে মৃগী রােগও বলা হয়। অনেক ক্ষেত্রে এই রােগের কারণে আক্রান্ত ব্যক্তি হঠাৎ করেই সাময়িকভাবে কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, শরীর কাঁপুনি ও খিচুনি দিতে দিতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। আগুন বা পানির সাথে এপিলেপ্সির লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার কোনাে সম্পর্ক নেই। কিন্তু রােগাক্রান্ত অবস্থায় কোথাও পড়ে গেলে রোগী নিজ শক্তিতে উঠতে পারে না। এই কারণে এসব রােগীকে জলাশয় বা আগুন কিংবা অন্যান্য বিপজ্জনক বস্তু বা স্থান থেকে দূরে রাখতে হয়। এপিলেপসির মূল কারণ এখনও সম্পূর্ণভাবে জানা যায়নি। স্ট্রোকে আক্রান্ত রােগীদের মৃগী রােগ দেখা দেয়। মাথায় আঘাতের কারণে ম্যানিনজাইটিস, এনসেফালাইটিস, জন্মগত মস্তিষ্কের বিকৃতি, টিউমার ইত্যাদি কারণেও এপিলেপসির উপসর্গ দেখা দেয়। এপিলেপসি যেকোনাে বয়সে হতে পারে। কোনাে কোনাে এপিলেপসির কোনাে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব নেই, আবার কোনােটা মস্তিষ্কের স্থায়ী ক্ষতি করতে পারে। তাই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে এপিলেপসির ধরন নির্ণয় করে সেই অনুযায়ী চিকিৎসা করা প্রয়ােজন। c) পারকিনসন রােগ (Parkinson's disease) পারকিনসন রােগ মস্তিষ্কের এমন এক অবস্থা, যেখানে হাতে ও পায়ের কাঁপুনি হয় এবং আক্রান্ত রােগীর নড়াচড়া, হাঁটাহাঁটি করতে সমস্যা হয়। এ রোগ সাধারণত 50 বছর বয়সের পরে হয়। তবে ব্যতিক্রম হিসেবে যুবক-যুবতীদেরও হতে পারে। এই ক্ষেত্রে রােগটি তার বংশে রয়েছে বলে ধরা হয়। স্নায়ু কোষ বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পদার্থ তৈরি করে থাকে, যার একটি হলাে ডােপামিন। ডােপামিন শরীরের পেশির নড়াচড়ায় সাহায্য করে। পারকিনসন রােগাক্রান্ত রােগীর মস্তিষ্কে ডোপামিন তৈরির কোষগুলাে ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যায়। ডােপামিন ছাড়া ঐ স্নায়ু কোষগুলাে পেশি কোষগুলােতে সংবেদন পাঠাতে পারে না। ফলে মাংসপেশি তার কার্যকারিতা হারায়। বয়স বাড়ার সাথে সাথে পারকিনসনের কারণে রােগীর মাংসপেশি আরও অকার্যকর হয়ে উঠে, ফলে রােগীর চলাফেরা, লেখালেখি ইত্যাদি কাজ করা কষ্টকর হয়ে পড়ে। পারকিনসন রােগ সাধারণত ধীরে ধীরে প্রকট রূপে দেখা দেয়। প্রাথমিক অবস্থায় রােগী হালকা হাত বা পা কাঁপা অবস্থায় থাকে। ফলে চলাফেরা বিঘ্নিত হয়। এছাড়াও চোখের পাতার কাঁপুনি, কোষ্ঠকাঠিন্য, খাবার গিলতে কষ্ট হওয়া, সােজাসুজি হাঁটার সমস্যা, কথা বলার সময় মুখের বাচনভঙ্গি না অসি অর্থাৎ মুখ অনড় থাকা মাংসপেশিতে টান পড়া বা ব্যথা হওয়া, নড়াচড়ায় কষ্ট হওয়া, যেমন চেয়ার থেকে উঠা কিংবা হটিতে শুরু করার সময় অসুবিধে হওয়া— এই ধরনের নানা উপসর্গ দেখা দিতে শুরু করে। ডাক্তারের পরামর্শে নিয়মিত ফিজিওথেরাপি গ্রহণ, পরিমিত খাদ্য গ্রহণ এবং সুশৃঙ্খল জীবন যাপন করার মাধ্যমে রােগী অনেকটা সুস্থ থাকে। একক কাজ কাজ : হরমােনজনিত শারীরিক সমস্যা সৃষ্টির কারণ অনুসন্ধান কর এবং একটি অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন তৈরি কর। 10.7 সমন্বয় কার্যক্রমে তামাক ও মাদকদ্রব্যের প্রভাব আমাদের দেশে সাধারণত তামাক, গাঁজা, ভাং, চরস, আফিম, মরফিন, কোকেন, মদ ইত্যাদি মাদকদ্রব্য | হিসেবে পরিচিত। এছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কোকেন ও আফিম থেকে কৃত্রিম উপায়ে ঔষধ তৈরি করা হচ্ছে। এগুলােও নেশার উদ্রেক করে। যেমন: ঘুমের ঔষধ। মানুষ কেন মাদকাসক্ত হয় তার বহুবিধ কারণ রয়েছে। তার মাঝে মাদকদ্রব্যের প্রতি কৌতুহল, বন্ধুবান্ধব এবং সঙ্গীদের প্রভাব, নতুন অভিজ্ঞতা অর্জনের আগ্রহ, সহজ আনন্দ লাভের চেষ্টা, পরিবারে মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতা, পারিবারিক কলহ এবং অশান্তি, বেকারত্ব, হতাশা, অভাব অনটন, মাদকদ্রব্যের কুফল সম্পর্কে অজ্ঞতা উল্লেখযােগ্য। তবে সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে ধারণা করা হচ্ছে যে মাদকাসক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হলাে স্বাভাবিক সামাজিক ও পারিবারিক সম্পর্কের ঘাটতি। তামাক ব্যবহারে, জর্দা চিবিয়ে খেলে কিংবা ধূমপান করলে রক্তে নিকোটিনের মাত্রা বেড়ে যায়। নিকোটিন প্রাথমিকভাবে স্নায়ু কোষগুলােকে উদ্দীপিত করে, পরবর্তীতে দেহে নিকোটিনের চাহিদা আরও বেড়ে যায়। নিকোটিনের এই চাহিদা মেটাতে জর্দা ব্যবহার বা ধূমপানের নেশায় মানুষ আসক্ত হয়ে পড়ে। নিকোটিন গ্রহণে ধীরে ধীরে স্নায়ুকোষের কার্যকারিতা নষ্ট হতে থাকে। হাত, পা কিংবা মাথা অনৈচ্ছিকভাবে কপিতে থাকে। ফলে কোনাে সূক্ষ্ম কাজ, যেমন সুইয়ের ছিদ্রে সুতা ঢোকানাে, সোজা দাগ টানা, লেখালেখিতে ব্যর্থতাজনিত সমস্যা ইত্যাদি দেখা দেয়। মাদকদ্রব্য ব্যবহারে স্নায়ুতন্ত্রের উপর অনেক বড় প্রভাব পড়ে। মাদকাশক্তির কারণে একজন তার নিজস্ব ইচ্ছাশক্তির কাছে হার মেনে নেশাদ্রব্য গ্রহণে বাধ্য হয়। নেশা বস্তুর কারণে তার চিন্তাশক্তি কমে লােপ পায়। মাদকদ্রব্য ব্যবহারকারীরা কাজে মনােযোগ হারায়, সাধারণ জীবনযাপনে ব্যর্থ হয়। অতিরিক্ত নেশায় অচৈতন্য অবস্থায় কোনাে স্থানে পড়েও থাকতে পারে। মাদকাপ্ত ব্যক্তি নির্দিষ্ট সময় পর পর মাদক গ্রহণ করতে না পারলে তার মারাত্মক কষ্ট হয়, এমনকি শরীরে অনিয়ন্ত্রিত খিচুনিও হতে পারে। এ জন্য মাদকের অর্থ জোগাড় করতে সেই ব্যক্তি অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ে। মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের সাহায্যে মাদকের নেশা থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব। তবে এ কাজে পরিবারের সবার সহানুভূতি ও সহযােগিতা অত্যন্ত জরুরি। মাদকাসক্তির কুফল: মাদকদ্রব্য সেবনের ফলে মানসিক, শারীরিক, সামাজিক ও আর্থিক ক্ষতিসাধন হয়।
এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায়:
•পারিবারিকভাবে এবং সামাজিকভাবে স্বাস্থ্যকর সম্পর্কের পরিবেশ বজায় রাখা।
• নৈতিক শিক্ষা কার্যক্রম প্রসার করা।
• বেকারদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা।
• অসৎ বন্ধুবান্ধব থেকে দূরে থাকা ও এর কুফল সম্পর্কে অবহিত করা।
•এ ব্যাপারে জনসচেতনতা গড়ে তােলা ও আইনের সঠিক প্রয়ােগ করা।

মাদকাসক্তদের ঘৃণা বা অবহেলার চোখে না দেখে তাদেরকে সহানুভূতির সাথে ধৈর্য সহকারে সমাজে পুনর্বাসন বা প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করা উচিত। প্রয়ােজনে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের সহায়তা গ্রহণ করা অপরিহার্য। এ উদ্দেশ্যে 1990 সালে বাংলাদেশ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর নামে একটি অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করা হয়। দিন দিন এ অধিদপ্তরের কাজের পরিধি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এদের কার্যক্রমের মধ্যে মাদকদ্রব্য আইন প্রণয়ন, আইনের প্রয়ােগ, নিরােধ, চিকিৎসা এবং পুনর্বাসন উল্লেখযােগ্য।
একক কাজ
কাজ : তামাক ও মাদকদ্রব্যের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে পােস্টার/লিফলেট অঙ্কন কর এবং শ্রেণিতে উপস্থাপন কর। অনুশীলনী (৭) সংক্ষিপ্ত উত্তর প্রশ্ন 1. ফাইটোহরমােন কী? 2. অভিকর্ষ উপলব্দি কী? 3. স্নায়ুতন্ত্র কাকে বলে? 4. কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র কী নিয়ে গঠিত? 5. প্যারালাইসিস কেন হয়? (3) রচনামূলক প্রশ্ন 1. উদ্ভিদের বৃদ্ধিতে হরমােনের ভূমিকা আলােচনা কর। 2. থাইরয়েড সমস্যার লক্ষণগুলাে লেখ। () বহুনির্বাচনি প্রশ্ন 1. থাইমাস গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হরমােন কোনটি? ক, থাইরক্সিন খ, প্যারাথাইরক্সিন গ. থাইমােক্সিন ঘ, থাইরােট্রপিন। 2. আইলেটস অফ ল্যাংগারহ্যানস— i. শরীরের শর্করা বিপাকে সহায়তা করে ii. ইনসুলিন হরমােন নিঃসরণ করে iii. দেহের বিপাকীয় কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে নিচের কোনটি সঠিক? ক. i খ. i ও ii গ. ii ও iii ঘ. i, ii ও iii নিচের চিত্রের আলোকে 3 ও 4 নং প্রশ্নের উত্তর দাও 3. চিত্রে ‘A’-এর ক্ষেত্রে কোনটি প্রযােজ্য। ক, আপােক দিকমুখীনতা খ. ভূ-দিকমুখীনতা গ. পানি দিকমুখীনতা ঘ. রাসায়নিক দিকমুখীনতা 4. চিত্রে ‘A’ অংশটি সৃষ্টিতে কোনটি কাজ করে? ক, অক্সিজেন খ, জিবেরেলিন গ. সাইটোকাইনিন ঘ, অ্যাবসিসিক এসিড (9) সৃজনশীল প্রশ্ন 1. অহনা বাবার সাথে কৃষি খামারে ঘুরতে যেয়ে বিভিন্ন ধরনের গাছ পর্যবেক্ষণ করে। সে দেখল, একটি করে আলাে জ্বালিয়ে ছােট ছােট চারা গাছ রাখা আছে এবং ঘরটি বেশ ঠাণ্ডা। সে আরও দেখল, কিছু ফলদ গাছের ফুল ফুটছে না, কিছু গাছে ছােট অবস্থায় ফলগুলাে ঝরে পড়ছে। ক. বায়ােলজিক্যাল ক্লক কী? খ. ভার্নালাইজেশন বলতে কী বােঝায়? গ. উদ্দীপকে ফলদ গাছগুলােতে এরূপ সমস্যার কারণ ব্যাখ্যা কর। ঘ, অহনার দেখা গাছগুলাে উক্ত পরিবেশে রাখার কারণ বিশ্লেষণ কর।
ক. প্রতিবর্তী ক্রিয়া কী?
খ. প্রাণরস কাকে বলে বুঝিয়ে লেখ।
গ. মানবদেহে উদ্দীপনা তৈরিতে চিত্রে ‘A’ চিহ্নিত অংশটির ভূমিকা ব্যাখ্যা কর।
ঘ. চিত্রের কোষটির গঠনপ্রকৃতি একটি সাধারণ কোষ অপেক্ষা ভিন্নতর যুক্তিসহ বিশ্লেষণ কর।



প্রধান শব্দভিত্তিক সারসংক্ষেপ

♦ মস্তিষ্ক: কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের সবচেয়ে সামনের অংশ বিশেষভাবে রূপান্তরিত হয়ে মস্তিষ্কে (মগজ / ঘিলু) পরিণত হয়েছে।
♦ মাস্টার গ্লান্ড: পিটুইটারি গ্রন্থিকে মাস্টার গ্লান্ড বলে কারণ এই গ্রন্থি অন্যান্য গ্রন্থিও কার্যাবলী নিয়ন্ত্রণ করে।
♦ ইনসুলিন: ইনসুলিন অগ্নাশয় থেকে নিসৃত একধরণের হরমোন যা গ্লুকোজকে গ্লাইকোজেন এ পরিণত করে।