এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত সব জীবদেহেই গ্যাসীয় আদান-প্রদান ঘটে। গ্যাসীয় বিনিময় জীবের একটি শারীরবৃত্তীয় কাজ। তবে উদ্ভিদ ও প্রাণীর গ্যাসীয় বিনিময় প্রক্রিয়া ভিন্নতর। উদ্ভিদ ও মানবদেহের গ্যাসীয় বিনিময় প্রক্রিয়া এ অধ্যায়ের আলােচ্য বিষয়।
এই অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা:
♦ উদ্ভিদে গ্যাসীয় বিনিময়ের ধারণা ব্যাখ্যা করতে পারব।
♦ মানুষের শ্বসনতন্ত্রের প্রধান অংশসমূহের কাজ ব্যাখ্যা করতে পারব।
♦ ফুসফুসের গঠন ও কাজ বর্ণনা করতে পারব।
♦ মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাস প্রক্রিয়া ও গ্যাসীয় বিনিময় বর্ণনা করতে পারব।
♦ + শ্বসনতন্ত্রের রােগ লক্ষণ, কারণ, প্রতিরােধ ও প্রতিকারের কৌশল ব্যাখ্যা করতে পারব।
♦ নিঃশ্বাসের সাথে নির্গত গ্যাসটির প্রকৃতি নির্ণয় করতে পারব।
♦ ফুসফুসের চিত্র অঙ্কন করে চিহ্নিত করতে পারব।
♦ শ্বসনতন্ত্রের রােগ প্রতিরােধে সচেতনতা সৃষ্টি করতে পারব।
7.1 উদ্ভিদে গ্যাসীয় বিনিময়
আমরা জানি যে উয়িদের জীবনে সালােকসংশ্লেষণ (Photosynthesis) এবং শ্বসন (Respiration) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুটি প্রক্রিয়া। মূলত এই দুটি শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উদ্ভিদের গ্যাসীয় বিনিময় ঘটে। থাকে। এই প্রক্রিয়া দুটি ঘটে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে। উদ্ভিদ সালােকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার জন্য বায়ু থেকে co, গ্রহণ করে এবং ০, ত্যাগ করে। অন্যদিকে শ্বসন প্রক্রিয়ায় জন্য 0 গ্রহণ করে এবং con ত্যাগ করে। উদ্ভিদে প্রাণীর মতাে শ্বাস নেওয়ার জন্য কোনাে বিশেষ অঙ্গ নেই, তবে পাতার স্টোমাটা ও পরিণত কাণ্ডের বাকলে লেন্টিসেলের (Lenticel) মাধ্যমে অক্সিজেন, কার্বন ডাই-অক্সাইড ও অন্যান্য। গ্যাসের বিনিময় ঘটে। তােমরা জান, দিনের বেলা বা পর্যাপ্ত আলাের উপস্থিতিতে সালােকসংশ্লেষণের হার অধিক হয়। সালােকসংশ্লেষণে উৎপাদিত অক্সিজেন গ্যাসের কিছু অংশ শ্বসন প্রক্রিয়ায় ব্যয় হয়। আবার শসন প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসের কিছু অংশ সালােকসংশ্লেষণে ব্যবহার হয়, তাই আদান-প্রদানকৃত অক্সিজেন ও কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসের পরিমাণ প্রায় সমান।
রাতের বেলা সালােকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার আলােক পর্যায় বন্ধ থাকে, তাই অক্সিজেন গ্যাস উৎপন্ন হয় না। অন্যদিকে দিবারাত্রি 24 ঘণ্টা শ্বসন প্রক্রিয়া সংঘটিত হয়, ফলে শ্বসন প্রক্রিয়ায় কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসের উৎপাদন চলতে থাকে। এ জন্য বড় গাছের নিচে রাত্রিবেলা ঘুমালে শ্বাসকষ্ট দেখা দিতে পারে। উদ্ভিদ তার পরিবেশ থেকে প্রয়ােজনীয় গ্যাস সংগ্রহ করে। উদ্ভিদের পাতা যেরকম বাতাস থেকে
অক্সিজেন ও কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস সংগ্রহ করে, তেমনি মূল মাটি থেকে পানি শােষণ করে। শােষিত সেই পানির সাথে co, এর বিক্রিয়ার ফলে 0, গ্যাস উৎপাদন হয়, যা বায়ুমণ্ডলে চলে যায়। এভাবে উদ্ভিদ দেহে গ্যাস বিনিময় চলতে থাকে।
7.2 মানব শ্বসনতন্ত্র
অক্সিজেন জীবনধারণের অপরিহার্য উপাদান। কোনাে প্রাণীই অক্সিজেন ছাড়া বাঁচতে পারে না। মানবদেহে বাতাসের সাথে অক্সিজেন ফুসফুসে প্রবেশ করে এবং তা রক্তের মাধ্যমে দেহের সব অঙ্গে পেচ্ছািয় ।। দেহকোষে পরিপাক হওয়া খাদ্যের সাথে অক্সিজেনের বিক্রিয়া ঘটে, ফলে তাপ এবং শক্তি উৎপন্ন হয়। এই তাপ দেহকে উষ্ণ রখে এবং প্রয়ােজনীয় শক্তি যোগায়। অক্সিজেন এবং খাদ্য উৎপাদনের মধ্যে বিক্রিয়ার ফলে কার্বন ডাই-অক্সাইড ও পানি উৎপন্ন হয়। বস্তু উপাদানগুলােকে ফুসফুসে নিয়ে যায়। যেখানে অক্সিজেন শােষিত হয় এবং কার্বন ডাই অক্সাইড ছেড়ে দেয়। যে প্রক্রিয়া দিয়ে অক্সিজেন গ্রহণ এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড নিষ্কাশন করা হয়, তাকে শাসকার্য। বলে। যে জৈবিক প্রক্রিয়া প্রাণিদেহের খাদ্যবস্তুকে বায়ুর অক্সিজেনের সাথে জারিত করে মজুত শক্তিকে ব্যবহারযােগ্য শক্তিতে রূপান্তর এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড নিষ্কাশন করে, তাকে শ্বসন বলে। দেহের ভিতর গ্যাসীয় আদান-প্রদান একবার ফুসফুসে এবং পরে দেহের প্রতিটি কোষে পর্যায়ক্রমে সম্পাদিত হয়। শ্বসনের সরল বিক্রিয়াটি এরকম:
C6H120% + 602 * 6CO2 + 6H50 + ATP গ্লুকোজ। | অক্সিজেন
কার্বন ডাই-অক্সাইড পানি শক্তি | সপ্তম শ্রেণিতে তােমরা জেনেছ প্রশ্বাসে অক্সিজেন গ্রহণ এবং নিঃশ্বাসে কার্বন ডাই-অক্সাইড দেহ
থেকে বের করতেই হয়, তা না হলে আমাদের পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়, কারণ তিন-চার মিনিটের বেশি দেহে অক্সিজেনের সরবরাহ বন্ধ থাকলে মৃত্যু অনিবার্য। দেহের সচেতন, অচেতন উভয়
অবস্থাতেই অবিরাম অক্সিজেন গ্রহণ এবং কার্বন ডাই-অক্সাইডের নির্গমন চলে। আর সাথে সাথে প্রতিনিয়ত দেহরক্ষার নানাবিধ প্রক্রিয়াও চলতে থাকে, যার ফলে প্রাণী বেঁচে থাকে।
7.2.1 শ্বসনতন্ত্র (Respriratory system):
যে অঙ্গগুলাের সাহায্যে শ্বাসকার্য পরিচালিত হয়, সেগুলােকে একত্রে শ্বসনতন্ত্র বলে। নিম্নলিখিত
শ্বসনতন্ত্রের সাথে সম্পৃক্ত অঙ্গগুলাে হলাে: নাসার এবং নাসাপথ, গলনালি বা গলবিল, স্বরযন্ত্র, শ্বাসনালি বা ট্রাকিয়া, বায়ুনালি বা ব্রংকাস, ফুসফুস এবং মধ্যচ্ছদা।
(a) নাসার ও নাসাপথ (Nasal cavity): শ্বসনতন্ত্রের প্রথম অংশের নাম নাসিকা বা নাক। এটা মুখগহ্বরের উপরে অবস্থিত একটি ত্রিকোণাকার গহ্বর। নাক বা নাসিকার সাহায্যে কোনাে বস্তুর সুগন্ধ বা দুর্গ বুঝা যায়। এক বিশেষ ধরনের স্নায়ু এই অঙ্গকে উদ্দীপিত করে, ফলে আমরা গন্ধ পাই। নাসিকা এমনভাবে বিবর্তিত হয়েছে যে সেটি প্রশ্বাসের সময় বাতাসকে ফুসফুসের গ্রহণের উপযােগী করে দেয়।
নাসাপথ সামনে নাসিকাছিদ্র এবং পিছনে গলবিল পর্যন্ত বিস্তৃত। একটি পাতলা প্রাচীর দিয়ে এটি দুই ভাগে বিভক্ত। এর সামনের অংশ লােমাবৃত এবং পিছনের অংশ শ্লেষ্য প্রস্তুতকারী একটি পাতলা পর্দা দিয়ে আবৃত। আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় বায়ুতে বিদ্যমান ধূলিকণা, রােগজীবাণু এবং আবর্জনা থাকলে তা এই লােম এবং পর্দাতে আটকে যায়। এতে বায়ু ফুসফুসে প্রবেশ করার পূর্বে কিছু পরিমাণে নির্মল হয়ে যায়। এছাড়া শ্বসনের জন্য গৃহীত বায়ু নাসাপথ দিয়ে যাওয়ার সময় কিছুটা উষ্ণ এবং আর্দ্র হয়। এর ফলে হঠাৎ ঠাণ্ডা বায়ু ফুসফুসে প্রবেশ করে সাধারণত কোনাে প্রকার ক্ষতি করতে পারে না।
| (b) পলবিল (Pharynx):
মুখ হাঁ করলে মুখগহ্বরের পিছনে যে অংশটি দেখা যায়, সেটাই গলবিল। নাসাপথের পিছনের অংশ থেকে স্বরযন্ত্রের উপরিভাগ পর্যন্ত এটি বিস্তৃত। এর পিছনের অংশের উপরিতলে একটি ছােট জিহবার মতাে অংশ থাকে, এটাই আলাজিহ্বা (Soft palate)। খাদ্য এবং পানীয় গলাধঃকরণের সময় এটা নাসাপথের পশ্চাৎপথ বন্ধ করে দেয়। ফলে কোনাে প্রকার খাদ্য নাসিকা পথে বাইরে আসতে পারে না। খাদ্যগ্রহণের সময় প্রচুর পরিমাণে পিচ্ছিল পদার্থ নিঃসরণ করাও এর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সম্ভবত উন্নততর স্বরযন্ত্রের বিবর্তনের সাথে আলাঞ্জির উদ্ভবের একটা সম্পর্ক আছে, যেটি কেবল মানুষের সবচেয়ে বেশি বিকশিত।
(c) স্বরযন্ম (Larynx): এটা গলবিলের নিচে এবং শ্বাসনালির উপরে অবস্থিত। স্বরযন্ত্রের দুই ধারে দুটি পেশি থাকে। এগুলােকে
(Vocal cord) বলে। স্বরযন্ত্রের উপরে একটি জিহ্বা আকৃতির ঢাকনা রয়েছে। একে উপজিহ্বা | (Epiglottis) বলে। শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার সময় এটি খােলা থাকে এবং এ পথে বাতাস ফুসফুসে
যাতায়াত করতে পারে। খাবার সময় ঐ ঢাকনাটা স্বরযন্ত্রের মুখ ঢেকে দেয় ফলে আহার্য দ্রব্যাদি সরাসরি খাদ্যনালিতে প্রবেশ করে। শ্বাস-প্রশ্বাসে এর কোনাে ভূমিকা নেই।
(d) শ্বাসনালি (Trachea): এটি খাদ্যনালির সামনে অবস্থিত একটি ফাঁপা নল। এই নালিটি স্বরযন্ত্রের নিচের অংশ থেকে শুরু করে কিছু দূর নিচে গিয়ে দুভাগে বিভক্ত হয়ে দুটি বায়ুনলের সৃষ্টি হয়, এগুলাে শ্বাসনালি। এর প্রাচীর কতগুলাে অসম্পূর্ণ বয়াকার তরুণাস্থি ও পেশি দিয়ে গঠিত। এর অন্তর্গাত্র ঝিল্লি দিয়ে আবৃত। এ ঝিল্লিতে সূক্ষ্ম লােমযুক্ত কোষ থাকে। এর ভিতর দিয়ে বায়ু আসা-যাওয়া করে। শ্বাসনালির ভিতর দিয়ে কোনাে অপ্রয়ােজনীয় বস্তুকণা প্রবেশ করলে সূক্ষ্ম লােমগুলাে সেগুলােকে শ্লেষ্মর সাথে বাইরে বের করে দেয়।
(e) ব্রংকাস (Bronchus): শ্বাসনালি স্বরযন্ত্রের নিমাংশ থেকে শুরু হয়ে ফুসফুসের নিকটবর্তী স্থানে গিয়ে ডান এবং বাম দিকে দুটি শাখায় বিভক্ত হয়। এ শাখাগুলো যথাক্রমে বাম এবং ডান ফুসফুসে প্রবেশ করে। এগুলাে ব্রংকাই (একবচনে ব্রংকাস) নামে পরিচিত। ফুসফুসে প্রবেশ করার পর ব্রংকাই দুটি অসংখ্য শাখা-প্রশাখায় বিস্ত হয়। এগুলােকে অণুক্রোম শাখা (bronehicole) বলে। এদের গঠনশৈলী শ্বাসনালির অনুরূপ।
(f) ফুসফুস (Lung): ফুসফুস শ্বসনতন্ত্রের প্রধান অঙ্গ। বক্ষগহ্বরের ভিতর হৃৎপিণ্ডের দুই পাশে দুটি ফুসফুস অবস্থিত। এটি স্পঞ্জের মতাে নরম এবং কোমল, হালকা লালচে রঙের। ডান ফুসফুস তিন খণ্ডে এবং বাম
ফুসফুস দুই খণ্ডে বিভক্ত। ফুসফুস দুই ভাঁজবিশিষ্ট পুরা নামক পর্দা দিয়ে আবৃত। দুই ভাঁজের মধ্যে এক প্রকার রস নির্গত হয়। ফলে শ্বাসক্রিয়া চলার সময় ফুসফুসের সাথে বক্ষগাত্রের কোনাে ঘর্ষণ হয় না। ফুসফুসে অসংখ্য বায়ুথলি বা বায়ুকোষ, সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম শ্বাসনালি ও রক্তনালি থাকে। বায়ুথলিগুলােকে বলে অ্যালভিওলাস (Alveolus)। বায়ুথলিগুলাে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অণুক্রোম শাখাপ্রাতে মৌচাকের মতাে অবস্থিত। নাসাপথ দিয়ে বায়ু সরাসরি বায়ুথলিতে যাতায়াত করতে পারে। বায়ুথলি পাতলা আবরণী দিয়ে আবৃত এবং প্রতিটি বায়ুথলি কৈশিকনালিকা দিয়ে পরিবেষ্টিত। বায়ু প্রবেশ করলে এগুলাে বেলুনের মতাে ফুলে ওঠে এবং পরে আপনা-আপনি সংকুচিত হয়। বায়ুথলি ও কৈশিক নালিকার গাত্র এত পাতলা যে এর ভিতর দিয়ে গ্যাসীয় আদান-প্রদান ঘটে।
) একক কাজ
কাজ : ফুসফুসের চিত্র অঙ্কন করে চিহ্নিত কর।
(g) মধ্যচ্ছদা (Diaphragm): বক্ষগহ্বর ও উদরগহবর পৃথককারী পেশিবহুল পর্দাকে মধ্যচ্ছদা বলে। এটি দেখতে অনেকটা প্রসারিত ছাতার মতাে। মধ্যচ্ছদা সংকুচিত হলে নিচের দিকে নামে, তখন বক্ষগহ্বরের আয়তন বৃদ্ধি পায়। এটি প্রসারিত হলে উপরের দিকে উঠে এবং বক্ষ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। মধ্যচ্ছদা প্রশ্বাস গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
7.2.2 শ্বাসক্রিয়া
শ্বাস-প্রশ্বাসের অঙ্গগুলাে কেবল গলবিলের দিকে খােলা, অন্য সবদিকে বন্ধ। ফলে নাসাপথের ভিতর দিয়ে ফুসফুসের বায়ুথলি পর্যন্ত বাতাস নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারে। স্নায়বিক উত্তেজনা দিয়ে শ্বাসকার্য
য। স্নায়বিক উত্তেজনার কারণে পিরাখির মাংসপেশি ও মধ্যচ্ছদা সংকুচিত হয়। ফলে মধ্যচ্ছদা নিচের দিকে নেমে যায় এবং বক্ষগহ্বর প্রসারিত হয়। বক্ষগহ্বরের আয়তন বেড়ে গেলে বায়ুর চাপ কমে যায়, ফলে ফুসফুসের ভিতরের বায়ুর চাপ বাইরের বায়ুর চাপের চেয়ে কমে যায়। বক্ষগহবরের ভিতর এবং বাইরের চাপের সমতা রক্ষার জন্য প্রশ্বাস বায়ু ফুসফুসের ভিতর সহজে প্রবেশ করতে পারে। এই পেশি সংকোচনের পরপরই পুনরায় প্রসারিত হয়। তাই মধ্যচ্ছদা পুনরায় প্রসারিত হয়ে উপরের দিকে উঠে যায় এবং বক্ষগহ্বরের আয়তন স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। এতে ফুসফুসের ভিতরের বায়ুর চাপ বেড়ে যায়, ফলে কার্বন ডাই-অক্সাইড ও জলীয় বায়ুসমৃদ্ধ বাতাস নিঃশ্বাসরূপে বাইরে বের হয়ে যায়। এভাবে মানবদেহে প্রতিনিয়ত শ্বাসকার্য চলতে থাকে। মূলত এটা বহিঃশ্বসন।
গ্যাসীয় বিনিময়
গ্যাসীয় বিনিময় বলতে অক্সিজেন ও কার্বন ডাই-অক্সাইড বিনিময়কে বুঝায়। এটি মূলত বায়ু ও ফুসফুসের রক্তনালির ভিতরে ঘটে। সব ধরনের গ্যাসীয় বিনিময়ের মূলে রয়েছে ব্যাপন প্রক্রিয়া। গ্যাসীয় বিনিময়কে দুটি পর্যায়ে ভাগ করা হয়, অক্সিজেন শােষণ ও কার্বন ডাই-অক্সাইড ত্যাগ।
অক্সিজেন শােষণ: ফুসফুসের বায়ুথলি বা অ্যালভিওলি ও রক্তের চাপের পার্থক্যের জন্য অক্সিজেন ব্যাপন প্রক্রিয়ায় রন্ধে প্রবেশ করে। ফুসফুস থেকে ধমনির রক্তে অক্সিজেন প্রবেশ করার পর রক্তে অক্সিজেন দুভাবে পরিবাহিত হয়। সামান্য পরিমাণ অক্সিজেন রক্তরসে দ্রবীভূত হয়ে পরিবাহিত হয়। বেশির ভাগ অক্সিজেনই | হিমােগ্লোবিনের লৌহ অংশের সাথে হালকা বন্ধনের মাধ্যমে অক্সিহিমােগ্লোবিন নামে একটি অস্থায়ী
যৌগ গঠন করে। অক্সিহিমােগ্লোবিন থেকে অক্সিজেন সহজে বিচ্ছিন্ন হতে পারে। | হিমােগ্লোবিন + অক্সিজেন → অক্সিহিমােগ্লোবিন (অস্থায়ী যৌগ) অক্সিাহিমােগ্লোবিন — মক্ক অক্সিজেন
* মুক্ত অক্সিজেন + হিমােগ্লোবিন রক্ত কৈশিনালিতে পৌঁছার পর অক্সিজেন পৃথক হয়ে প্রথমে লােহিত রক্তকণিকার আবরণ ও পরে কৈশিনালির প্রাচীর ভেদ করে লসিকাতে প্রবেশ করে। অবশেষে লসিকা থেকে কোষ আবরণ ভেদ করে | কোষে পৌঁছে।
কার্বন ডাই-অক্সাইড পরিবহন: খাদ্য জারণ বিক্রিয়া কোষে কার্বন ডাই-অক্সাইড তৈরি করে। এই কার্বন ডাই-অক্সাইড প্রথমে কোষ আবরণ ভেদ করে আন্তঃকোষীয় তরল ও লসিকাতে প্রবেশ করে এবং সেখান থেকে কৈশিকনালির প্রাচীর ভেদ করে রক্তরসে প্রবেশ করে। কার্বন ডাই-অক্সাইড প্রধানত সােডিয়াম বাইকার্বোনেট (NalIC0) রূপে রক্তরসের মাধ্যমে এবং পটাশিয়াম বাই কার্বোনেট KHC0, রূপে লােহিত রক্তকণিকা দিয়ে পরিবাহিত হয়ে ফুসফুসে আসে, সেখানে কৈশিকনালি ও বায়ুথলি ভেদ করে দেহের বাইরে নির্গত হয়।
একক কাজ
কাজ: নিঃশ্বাসের সাথে নির্গত গ্যাসের প্রকৃতি নির্ণয়।
উপকরণ: দুটি টেস্টটিউব, একটি 10 mL ইনজেকশন সিরিঞ্জ (সুচ বাদে), দুটি
প্লাস্টিকের নল (যার অন্তত একটি নল | সিরিঞ্জের মুখে বায়ুরােধী করে আটকানাে
যায়) এবং চুনের পানি।
পদ্ধতি: টেস্টটিউব দুটিতে সমপরিমাণ চুনের পানি নিতে হবে। তারপর দুটি টেস্টটিউবের প্রতিটির মধ্যে একটি করে নল এমনভাবে প্রবেশ করাতে হবে যাতে দুটি নলেরই | এক প্রান্ত চুনের পানিতে ডুবে থাকে। এবার একটি নলের এক প্রান্ত সিরিঞ্জের মুখে বায়ুরােধী করে আটকাতে হবে। তবে
আটকানাের আগে সিরিঞ্জের পিস্টন প্রায় পুরােটা টেনে 10 mL দাগ পর্যন্ত নিতে হবে। নলের সাথে সিরিঞ্জ আটকানাের পর পিস্টন পুরােটা চেপে দিতে হবে। এর ফলে টেস্টটিউবের চুনের পানির মধ্যে বুদ্বুদ সৃষ্টি হবে। একইভাবে আরও কয়েকবার বায়ু চালনা করে। অপর টেস্টটিউবে চুনের পানিতে ডােবানাে নলের উপরের প্রান্তে মুখ লাগিয়ে শ্বাস ছাড়তে থাকো, শ্বাস ছাড়ার সময় নাক চেপে ধরলে ভালাে হয়। তবে শ্বাস নেওয়ার সময় নল থেকে প্রতিবার মুখ সরিয়ে নাও। উভয় টেস্টটিউবের চুনের পানি প্রায় 15 সেকেন্ড ধরে পর্যবেক্ষণ করাে। টেস্টটিউব দুটির কোনােটিতেই পরিবর্তন না ঘটলে আরও 15 সেকেন্ড ধরে পরীক্ষা চালাতে থাকো।
পর্যবেক্ষণ: একটু লক্ষ করলে দেখতে পাবে যে টেস্টটিউবের চুনের পানিতে সিরিঞ্জের মাধ্যমে সাধারণ বাতাস চালনা করা হয়েছে সেটিতে কোনাে পরিবর্তন হয়নি। আর যেটিতে নিঃশ্বাস বায়ু চালনা করা হয়েছে, সেটি ঘােলা হয়ে দুধের মতাে রং ধারণ করেছে। সিদ্ধান্ত: নিঃশ্বাস বায়ুতে কার্বন ডাই-অক্সাইডের উপস্থিতির ফলে চুনের পানি ঘােলা হয়ে গেছে। কারণ নিঃশ্বাস বায়ুতে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ সাধারণ বাতাসের (যা আমরা প্রশ্বাসের সাথে গ্রহণ করি) তুলনায় বেশি থাকে। এজন্য সাধারণ বায়ু চালনা করায় চুনের পানির কোনাে পরিবর্তন হয়নি।
একক কাজ
কাজ : নিচের ছকটি পূরণ কর।
7.3 শ্বাসনালি-সংক্রান্ত রােগ
ফুসফুস শ্বসনতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে অনেক সময় এ অশটি নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বায়ুদূষণ এবং বিভিন্ন প্রকার ভাসমান কণা এবং রাসায়নিকের প্রভাবেও ফুসফুস অসুস্থ হতে পারে। অনেক সময় অজ্ঞতা ও অসাবধানতার কারণে ফুসফুসে নানা জটিল রােগ দেখা দেয় এবং সংক্রমণ ঘটে। ফুসফুসের সাধারণ রােগগুলাের কারণ, লক্ষণ, প্রতিকার। ও সাবধানতাগুলাে জানা থাকলে অনেক জটিল সমস্যা এমনকি মৃত্যুঝুঁকিও অনেকাংশে কমানাে যায়।
(a) অ্যাজমা বা হাঁপানি (Asthma) অ্যাজমা সাধারণত রােগ প্রতিরােধ-ব্যবস্থার অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়ার ফলে হয়ে থাকে। অর্থাৎ কোনাে একটি বহিঃস্থ পদার্থ ফুসফুসে প্রবেশ করলে সেটিকে নিষ্ক্রিয় করতে দেহের প্রতিরােধ ব্যবস্থার যেটুকু প্রতিক্রিয়া দেখানাের কথা, তার চেয়ে অনেক তীব্রভাবে প্রতিক্রিয়া ঘটলে অ্যাজমা হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রেই অ্যাজমা আক্রান্ত শিশু বা ব্যক্তির বংশে হাঁপানি বা অ্যালার্জির ইতিহাস থাকে। এটি ছোঁয়াচে নয়, জীবাণুবাহিত রােগও নয়।
কারণ: যেসব খাবার খেলে এলার্জি হয় (চিংড়ি, গরুর মাংস, ইলিশ মাছ ইত্যাদি), বায়ুর সাথে ধোঁয়া, ধুলাবালি, ফুলের রেণু ইত্যাদি শ্বাস গ্রহণের সময় ফুসফুসে প্রবেশ করলে হাঁপানি হতে পারে। শিশুদের ক্ষেত্রে সাধারণ সর্দি কাশি থেকে হাঁপানি হওয়ার আশংকা থাকে। বছরের বিশেষ ঋতুতে বা ঋতু পরিবর্তনের সময় এ রােগ বেড়ে যেতে পারে।
♦ লক্ষণ : • হঠাৎ শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়।
• শ্বাসকষ্টে দম বন্ধ হওয়ার মতাে অবস্থা সৃষ্টি হয়, ঠোঁট নীল হয়ে যায়, গলার শিরা ফুলে যায়।
• রােগী জোরে জোরে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করে, এ সময় বুকের ভিতর সাঁই সাঁই আওয়াজ হয়।
• ফুসফুসের বায়ুথলিতে ঠিকমতাে অক্সিজেন সরবরাহ হয় না বা বাধাগ্রস্ত হয়, ফলে রােগীর
বেশি কষ্ট হয়।
• কাশির সাথে কখনাে কখনাে সাদা কফ বের হয়।
• সাধারণত জ্বর থাকে না।
• শ্বাস নেওয়ার সময় রােগীর পাঁজরের মাঝে চামড়া ভিতরের দিকে ঢুকে যায়।
• রােগী দুর্বল হয়ে পড়ে।
প্রতিকার :
• চিকিৎসায় এ রােগ সম্পূর্ণ নিরাময় হয় না। তবে ঔষধ সেবনে রােগী কিছুটা আরাম বােধ করে।
• যেসব খাদ্য খেলে শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়, সেগুলাে না খাওয়া।
• আলো-বাতাসপূর্ণ গৃহে বসবাস করা। যেসব জিনিসের সংস্পর্শ হাঁপানি বাড়ায় তা ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকা। যেমন- পশুর ললাম, কৃত্রিম আঁশ ইত্যাদি।
• ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা নেওয়া ও সাবধানতা অবলম্বন করা।
• ধূমপান, গুল, সাদা পাতা, জর্দা ইত্যাদির ব্যবহার পরিহার করা।
• শ্বাসকষ্টের সময় রােগীকে তরল খাদ্য খাওয়নাে।
প্রতিরোধ :
• স্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাস করা।
• বায়ুদূষণ, বাসস্থান বা কর্মক্ষেত্রে শ্বাসকষ্ট হতে পারে, এমন সব বস্তুর সংস্পর্শ পরিহার করা। | হাঁপানি রােগীর শ্বাসকষ্ট লাঘবের জন্য সবসময় সাথে ঔষধ রাখা ও প্রয়োজনমতাে ব্যবহার করা।
এখানে লক্ষণীয় যে হাতুড়ে চিকিৎসকেরা অনেক সময় উচ্চমাত্রায় ক্ষতিক্ষারক স্টেরয়েড দিয়ে এর চিকিৎসা করে থাকে, যেটি উচ্চমাত্রায় প্রয়ােগ করলে রােগীর কষ্ট তাৎক্ষণিকভাবে উপশম হলেও দীর্ঘমেয়াদি এবং অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যায়। তাই এ ধরনের চিকিৎসা বা চিকিৎসক থেকে দূরে থাকতে হবে।
(b) ব্রংকাইটিস (Bronchitis) শ্বাসনালির ভিতরে আবৃত প্রদাহকে ব্রংকাইটিস বলে। ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে ঝিল্লিগাত্রে প্রদাহ হতে পারে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, স্যাঁতসেঁতে ধূলিকণা মিশ্রিত আবহাওয়া, ঠাণ্ডা লাগা এবং ধূমপান থেকেও এ রােগ হওয়ার আশংকা থাকে। একবার ব্রংকাইটিস হলে বারবার এ রােগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সাধারণত শিশু এবং বয়স্ক ব্যক্তিরা এ রােগে বেশি আক্রান্ত হয়। ধূমপান, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও দূষণ (যেমন কলকারখানার ধুলাবালি এবং ধোঁয়াময় পরিবেশ) এ রােগের কারণ হিসেবে গণ্য করা হয়।
♦ লক্ষণ : • কাশি, বুকে ব্যথা ও শ্বাসকষ্ট হয়।
• কাশির সময় রােগী বুকে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করে।
• শক্ত খাবার খেতে পারে না।
• কাশির সাথে অনেক সময় কফ বের হয়। যদি কমপক্ষে একটানা 3 মাস কাশির সাথে কফ
থাকে এবং এরকম অসুস্থতা পরপর 2 বছর দেখা যায়, তাহলে রােগীর ক্রনিক ব্রংকাইটিস হয়ে থাকতে পারে।
প্রতিকার :
• ধূমপান, মদ্যপান, তামাক বা সাদাপাতা খাওয়া বন্ধ করা।
• ডাক্তারের পরমার্শ অনুযায়ী রােগীর চিকিৎসা করানাে।
• রোগীকে সহনীয় উষ্ণতা ও শুষ্ক পরিবেশে রাখা।
• পুষ্টিকর তরল ও গরম খাবার খাওয়ানাে। যেমন: গরম দুধ, স্যুপ ইত্যাদি।
• রােগীর পূর্ণ বিশ্রাম নেওয়া।
প্রতিরোধ :
• ধূমপান ও তামাক সেবনের মতাে বদ অভ্যাস ত্যাগ করা।
• ধুলাবালি ও ধোঁয়াপূর্ণ পরিবেশে কাজ করা থেকে বিরত থাকা।
• শিশু বা বয়স্কদের যেন মাথায় ঠাণ্ডা না লাগে সেদিকে নজর রাখা।
(c) নিউমােনিয়া (Pneumonia) নিউমােনিয়া একটি ফুসফুসের রােগ। অত্যধিক ঠাণ্ডা লাগলে এ রােগ হতে পারে। হাম ও ব্রংকাইটিস রােগের পর ঠাণ্ডা লেগে নিউমােনিয়া হতে দেখা যায়। শিশু এবং বয়স্কদের জন্য এটি একটি মারাত্মক রােগ। কারণ: নিউমােকক্কাস (Pneumococcus) নামক ব্যাকটেরিয়া এ রােগের অন্যতম কারণ। এছাড়া আরও বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও ছত্রাকের আক্রমণে নিউমােনিয়া হতে পারে। এমনকি বিষম খেয়ে খাদ্যনালির রস শ্বাসনালিতে ঢুকলে সেখান থেকেও নিউমােনিয়া হতে পারে।
♦ লক্ষণ :
• ফুসফুসে প্লেস্মা-জাতীয় তরল পদার্থ জমে কফ সৃষ্টি হয়। • কাশি ও শ্বাসকষ্ট হয়। • দেহের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায় অর্থাৎ বেশি জ্বর হয়।
• চুড়ান্ত পর্যায়ে বুকের মধ্যে ঘড়ঘড় আওয়াজ হয়, মারাত্মক শ্বাসকষ্ট হয় ।
প্রতিকার
• ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী রােগীর সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা। • তরল ও গরম পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানাে। • বেশি করে পানি পান করানাে।
♦ প্রতিরােধ :
• শিশু ও বয়স্কদের যেন ঠাণ্ডা না লাগে, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা।
• ধূমপান পরিহার করা।
• আলো-বাতাসপূর্ণ গৃহে বসবাস করা।
• রােগীকে সহনীয় উষ্ণতায় ও শুষ্ক পরিবেশে রাখা।
(d) যক্ষ্মা (Tuberculosis) যক্ষ্মা একটি পরিচিত বায়ুবাহিত সংক্রামক রোগ। তবে ক্ষেত্রবিশেষে যক্ষ্মার জীবাণুযুক্ত ত্বকের ক্ষতের সংস্পর্শে এলে কিংবা সংক্রমিত গরুর দুধ খেয়েও কেউ এ রােগে আক্রান্ত হতে পারে। উল্লেখ্য, যেকোনাে লােক, যেকোনাে সময়ে এ রোগ দ্বারা সংক্রমিত হতে পারে। যারা অধিক পরিশ্রম করে, দুর্বল, স্যাঁতসেঁতে বা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাস করে, অপুষ্টিতে ভােগে অথবা যক্ষ্মা রােগীর সাথে বসবাস করে, তারা এ রােগে সহজে আক্রান্ত হয়। আমাদের অনেকের ধারণা, যক্ষ্মা শুধু ফুসফুসের রােগ। আসলে ধারণাটা একেবারেই সঠিক নয়। যক্ষ্মা অন্ত্র, হাড়, ফুসফুস এরকম দেহের প্রায় যেকোনাে স্থানে হতে পারে।
দেহে এ রােগের আক্রমণ ঘটলে সহজে এর লক্ষণ প্রকাশ পায় না। যখন জীবাণুগুলাে দেহের রােগ প্রতিরােধক শ্বেত রক্তকণিকাকে পরাস্ত করে দেহকে দুর্বল করে, তখনই এ রােগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। কারণ: সাধারণত Mycobacterium tuberculosis নামক এক ধরনের ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে এ রােগ হয়। তবে Mycobacterium গণভুক্ত আরও কিছু ব্যাকটেরিয়া যক্ষ্মা সৃষ্টি করতে পারে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করলে অতি সহজে দেহে রােগ জীবাণুর বিস্তার ঘটে। রােগ নির্ণয় কফ পরীক্ষা, চামড়ার পরীক্ষা (MT test), সাইটো ও হিস্টোপ্যাথলজি পরীক্ষা এবং এক্স-রের সাহায্যে এ রােগ নির্ণয় করা যায়। তবে যক্ষ্মায় ঠিক কোন অঙ্গটি আক্রান্ত হয়েছে, তার উপরে নির্ভর করবে কোন পরীক্ষাটি করতে হবে। বর্তমানে রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে রােগটি নিশ্চিতভাবে নির্ণয় করা যায় কিনা তা নিয়ে গবেষণা চলছে। ইদানীং আমাদের দেশে রােগীর কফসহ বিভিন্ন নমুনায় যক্ষা জীবাণু আছে কি না তা নির্ণয়ের জন্য DNA ভিত্তিক পরীক্ষা চালু হয়েছে।
লক্ষণ
• রােগীর ওজন কমতে থাকে, আস্তে আস্তে শরীর দুর্বল হতে থাকে।
• সাধারণত তিন সপ্তাহের বেশি সময় কাশি থাকে।
• খুসখুসে কাশি হয় এবং কখনাে কখনাে কাশির সাথে রক্ত যায়।
• রাতে ঘাম হয়, বিকেলের দিকে জ্বর আসে। দেহের তাপমাত্রা খুব বেশি বাড়ে না।
• বুকে পিঠে ব্যথা হয়।
• অজীর্ণ ও পেটের পীড়া দেখা দেয়।
♦ প্রতিকার :
• ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা করা।
• এ রােগের চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি। ডাক্তারের পরমার্শ অনুযায়ী রােগ নিবারণের নিয়মগুলাে
কঠিনভাবে মেনে চলা।
• প্রয়ােজনে রােগীকে হাসপাতালে বা স্যানাটোরিয়ামে পাঠানাে।
• রােগীর ব্যবহারের সবকিছু পৃথক রাখা। • রােগীর কফ বা থুতু মাটিতে পুঁতে ফেলা।
• রােগীর জন্য উপযুক্ত চিকিৎসা ও পরিমিত পুষ্টিকর খাদ্যের ব্যবস্থা রাখা।
• ডাক্তারের নির্দেশ ব্যতীত কোনাে অবস্থায় ঔষধ সেবন বন্ধ না করা।
প্রতিরোধ :
• এ মারাত্মক রােগের আক্রমণ থেকে রেহাই পেতে হলে শিশুদের যক্ষ্মা প্রতিষেধক বিসিজি টিকা।
দিতে হবে। শিশুর জন্মের পর থেকে এক বছর বয়সের মধ্যে এ টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে
হয়। বিসিজি টিকা শিশুদের প্রাণঘাতী যক্ষ্মা থেকে সুরক্ষা দিলেও বড় হয়ে গেলে তা সাধারণত
আর কার্যকর থাকে না। তাই শিশু বয়সে টিকা দিলে তা আজীবন যক্ষ্মা থেকে সুরক্ষা দেয় না।
• বর্তমানে দেশের বিভিন্ন টিকাদান কেন্দ্রে এ টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে।
(e) ফুসফুসের ক্যান্সার (Lung cancer) সব ধরনের ক্যান্সারের মধ্যে ফুসফুস ক্যান্সারের প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি। আমাদের দেশে পুরুষের। ক্যান্সারজনিত মৃত্যুর প্রধান কারণ ফুসফুস ক্যান্সার। ফুসফুস ক্যান্সারের অন্যতম প্রধান কারণ ধূমপান।
• বায়ু ও পরিবেশদূষণ এবং বাসস্থান অথবা কর্মক্ষেত্রে দূষণ ঘটতে পারে এমন সব বস্তুর (যেমন; এ্যাসবেস্টাস, আর্সেনিক, ক্রোমিয়াম, নিকেল, কঠিন ধাতুর গুঁড়া ইত্যাদি) সংস্পর্শে
আসার কারণে ফুসফুসে ক্যান্সার হয়।
• যক্ষ্মা বা কোনাে ধরনের নিউমােনিয়া ফুসফুসে এক ধরনের ক্ষত সৃষ্টি করে যা পরবর্তীতে
ক্যান্সারে রূপান্তরিত হয়।
লক্ষণ:
ফুসফুস ক্যান্সারের প্রাথমিক লক্ষণগুলাে যত দ্রুততার সাথে নির্ণয় করা যায় এবং চিকিৎসা প্রদান। করা যায়, তত বেশি দিন বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। প্রাথমিক অবস্থায় যেসব লক্ষণ প্রকাশ পায়। সেগুলাে হলাে:
দীর্ঘদিন ধরে খুসখুসে কাশি ও বুকে ব্যথা।
• ভগ্নশ্বর, ওজন হ্রাস এবং ক্ষুধামান্দ্য।
• হাঁপানি, ঘনঘন জ্বর হওয়া।
• বারবার ব্রংকাইটিস বা নিউমােনিয়া দিয়ে সংক্রমিত হওয়া। রােগ নির্ণয় প্রাথমিক অবস্থায় ক্যান্সারের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য থুথু বা শ্লেষা বিশ্লেষণ করা, বুকের এক্স-রে, সিটি স্ক্যান, এমআরআই ইত্যাদি করতে হয়। চূড়ান্ত রােগনির্ণয়ের জন্য সাধারণত সাইটো ও হিস্টোপ্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা করতে হয়।
♦ প্রতিকার :
প্রতিকার :
• রােগের লক্ষণগুলাে দেখা গেলে অনতিবিলম্বে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া।
• রােগ নির্ণয়ের পর ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা।
• প্রয়ােজনে রেডিয়েশন থেরাপি প্রয়ােগ করা, যেখানে তেজস্ক্রিয় বিকিরণের মাধ্যমে ক্যান্সার
কোষ ধ্বংস করা হয়।
প্রতিরােধ বিশেষজ্ঞদের মতে, ক্যান্সার প্রতিরােধে নিম্নলিখিত ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে, যথা:
• ধূমপান ও মদ্যপান না করা।
• অতিরিক্ত চর্বিজাতীয় খাদ্য না খাওয়া।
• নিয়মিত ব্যায়াম করা।
• পরিমাণমতাে শাকসবজি খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তােলা।
▣ অনুশীলনী
)
৫) সংক্ষিপ্ত উত্তর প্রশ্ন
1. কোষীয় শ্বসন কাকে বলে? 2. পুরার কাজ কী? 3, ব্রংকাইটিস কী? 4, মধ্যচ্ছদার কাজ কী? | 5, নিউমােনিয়া কেন হয়?
(
৩) রচনামূলক প্রশ্ন।
1. যক্ষ্মা রােগের লক্ষণগুলাে লেখ।
ক) বহুনির্বাচনি প্রশ্ন
1. নিচের কোনটির সংক্রমণে যক্ষ্মা হয়? ক, ভাইরাস। খ, ব্যাকটেরিয়া
ঘ, প্রােটোজোয়া
iii. মূলরােম
2. উদ্ভিদের গ্যাসীয় বিনিময়ে সাহায্য করে
i. স্টোমাটা ii. লেন্টিসেল নিচের কোনটি সঠিক? ক. i ও ii খ. i ও iii
গ. ii ও iii
ঘ. i, ii ও iii
নিচের উদ্দীপকটি পড়ে 3 ও 4 নং প্রশ্বের উত্তর দাও। শারীরিক দুর্বলতার জন্য রিতা ডাক্তারের শরণাপন্ন হলাে। ডাক্তার তার দেহে রক্কের একটি বিশেষ কণিকার অপর্যাপ্ততার কথা জানান। ঘাটতি পূরণে ডাক্তার তাকে পুষ্টিকর খাবার ও শাকসবজি অধিক পরিমাণে খেতে পরামর্শ দিলেন। 3. রিতার রক্তে কোনটির অভাব রয়েছে?
ক, লােহিত রক্তকণিকা খ. শ্বেত রক্তকণিকা গ, অণুচক্রিকা। |
ঘ, রক্তরস 4. বিশেষ কণিকাটি—
i. লৌহ উপাদান যুক্ত ii. অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে iii. কার্বন ডাই-অক্সাইড ধারণ করে
নিচের কোনটি সঠিক? ক. i ও ii খ. i ও iii
গ. ii
ও iii
(9) সৃজনশীল প্রশ্ন।
ক, রক্তের কোন কণিকা অক্সিজেন বহন করে? খ. ট্রাকিয়া বলতে কী বােঝায়? গ. চিত্রে P-এর সংঘটিত প্রক্রিয়াটি ব্যাখ্যা কর।
ঘ, চিত্রে গ্যাস বিনিময়ের ক্ষেত্রে P ও Q একে অপরের উপর নির্ভরশীলতার বিষয়টি তােমার যুক্তির
আলােকে বিশ্লেষণ কর। 2. রাশেদ ও জামিল জাহাজ ভাঙা শিল্পে কাজ করেন। কাশি ও বুকে ব্যথাসহ অন্যান্য শারীরিক সমস্যায় ভােগায় উভয়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হন। ডাক্তার বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর নিশ্চিত হন যে রাশেদের শ্বসন অঙ্গের কোষ বিভাজন অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে জামিলের রোগটি শ্বসন অল ছাড়াও অন্ত্র ও হাড়ে বিস্তার লাভ করেছে।
ক, মধ্যচ্ছদা কী? খ. বহিঃশ্বসন বলতে কী বােঝায়? গ, রাশেদের দেহে রােগটি কীভাবে ছড়ায়? ব্যাখ্যা কর। ঘ, রাশেদ ও জামিলের রােগ দুটির মধ্যে কোনটির নিরাময় তুলনামূলকভাবে সহজতর কারণ। বিশ্লেষণ কর।
▣ প্রধান শব্দভিত্তিক সারসংক্ষেপ
♦ জীববৈচিত্র্য :
জীবের জিনগত, প্রজাতিগত ও পরিবেশগত বৈচিত্র্যকে একসঙ্গে জীববৈচিত্র্য বলা হয়।